স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে টিকা কম। বেক্সিমকো ও সেরাম আপাতত টিকা দিতে পারছে না। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের তাগিদ।
বেক্সিমকো ফার্মা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে সময়মতো করোনার টিকা সরবরাহ করতে পারছে না। বেক্সিমকো সরকারকে বলেছে, সরকার যেন টিকার জন্য ভারত সরকারকে সর্বাত্মকভাবে অনুরোধ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লেখা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চিঠিতে এ কথা বলা হয়েছে।
গত রোববার বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাব্বুর রেজার এই চিঠি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিবকে দেওয়া হয়েছে। চিঠির শেষে বলা হয়েছে, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমোদন প্রদানে ভারত সরকারকে আরও আন্তরিক হতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক অনুরোধ করা একান্ত আবশ্যক।’ এ চিঠির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সরকারকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মতো টিকা আনার চেষ্টা করছি। সরকারও চেষ্টা করলে ভালো হয়।’
বেক্সিমকো এমন সময় এই চিঠি সরকারকে দিল, যখন দেশে একই সঙ্গে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে ৫৭ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজের টিকা দিয়েছে। এ ছাড়া ১৬ লাখের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছে। প্রথম ডোজ দেওয়া প্রত্যেককে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মতো টিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে নেই। বর্তমানে অধিদপ্তরের কাছে ৩০ লাখের কম টিকা রয়েছে।
গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেক্সিমকো ও সেরাম ইনস্টিটিউটকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেরাম ইনস্টিটিউট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উত্তরে জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য টিকা প্রস্তুত রাখা আছে। ভারত সরকার অনুমতি দিলে তারা টিকা পাঠাতে পারবে।
সরকারকে টিকা সংগ্রহের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রথম ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহ করতে হবে।অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, চেয়ারম্যান, ফার্মাকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বেক্সিমকো ও সেরামের চিঠির পর ভারত থেকে আপাতত টিকা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা দুই দিন আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, টিকার ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেছেন, সেরাম ইনস্টিটিউট যাতে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত টিকার বাকি অংশ সরবরাহ করে, সে জন্য ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
করোনার টিকা নিয়ে সরকার, বেক্সিমকো ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে চুক্তি আছে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারকে মোট ৩ কোটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড সরবরাহ করার কথা। চুক্তি অনুযায়ী ছয় মাসে ৩ কোটি ডোজ সরবরাহ করবে সেরাম। জানুয়ারিতে ৫০ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে ২০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করে বেক্সিমকো। এ পর্যন্ত তারা ৩ কোটি ডোজের মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ৩৩ লাখ টিকা ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে টিকা রপ্তানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার খবর জানা যায়। এর পর থেকে টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
বেক্সিমকো গত রোববারের চিঠিতে জানিয়েছে, তারা টিকা সরবরাহের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তাগাদা প্রদান অব্যাহত রাখছে। কিন্তু প্রতিবারই সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ ভারত সরকারের বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুমোদন না পাওয়ার কথা জানিয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতা অবহেলাজনিত শৈথিল্য নয়, শুধু ভারত সরকারের রপ্তানি অনুমোদন না পাওয়ায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের একমাত্র কারণ বলে বেক্সিমকো জানতে পেরেছে। বেক্সিমকো বলেছে, তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও প্রস্তুত রেখেছে। একইভাবে সেরামও চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বিশেষ আন্তরিক। তা সত্ত্বেও যথাসময়ে করোনার টিকা সরবরাহের বিষয়টি এখন ভারত সরকারের বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রপ্তানি অনুমোদন পাওয়ার ওপরই নির্ভরশীল।
এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সেরাম এক চিঠিতে তাদের অপারগতার কথা বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসানকে জানায়। ভারত সরকার রপ্তানির অনুমতি না দিলে তাদের কিছুই করার নেই জানিয়ে চিঠি লিখেছিল সেরাম।
এদিকে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে ১২ এপ্রিল পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছেন, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে রাশিয়ায় উৎপাদিত করোনার টিকা স্পুতনিক-ভি বাংলাদেশে আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করার কথা বলা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রুশ রাষ্ট্রদূত কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। তার মধ্যে আছে: বাংলাদেশের জন্য স্বল্প মেয়াদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে কী পরিমাণ করোনার টিকা প্রয়োজন, টিকা আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি যেসব মন্ত্রণালয় বা সংস্থা অথবা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমদানি করা হবে, তাদের সম্ভাব্য তালিকা এবং বাংলাদেশে অবিলম্বে টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্ভাব্য তালিকা।
এরপর ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে এসব তথ্য চেয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি পাঠানো হয়। ওই দিনই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাংলাদেশে আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম পাঠিয়েছেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছে, বাংলাদেশের জন্য স্বল্প মেয়াদে প্রায় ৩ কোটি ডোজ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ১৪ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। এই টিকা আমদানির জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইপিআই, সিএমএসডি, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সক্ষম।
এদিকে কোভিড-১৯ টিকা প্রাপ্তি ও সংগ্রহের বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া প্রস্তাব পরীক্ষা করে এ ব্যাপারে মতামত দিতে সাত সদস্যের কমিটির আজ বুধবার প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই কমিটি বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া টিকার প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে সুনির্দিষ্ট মতামত দেবে। এ ছাড়া কমিটি টিকা সরবরাহ করার প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, টিকা ব্যবহারকারী দেশের তথ্য, করোনার টিকা ক্রয় প্রস্তাব দেওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, সরকার রাশিয়া, চীনের পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে টিকা পাওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে গ্যাভি-কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি বাংলাদেশকে ১ লাখ ৬১০ ডোজ টিকা বিনা মূল্যে সরবরাহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চায়না সিনোফার্ম ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন তাদের উৎপাদিত ৫ লাখ টিকা বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দেবে বলে জানিয়েছে।
দেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে জোর টিকা কূটনীতি লক্ষ করা যায়। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে কেনা টিকা আসার আগেই ভারত বাংলাদেশকে ২০ লাখ টিকা উপহার হিসেবে পাঠায়। গণমাধ্যম যখনই টিকার বিষয়ে জানতে চেয়েছে, বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে যে তারা নির্দিষ্ট সময়ে টিকা আনতে পারবে।
গণটিকাদান শুরু হলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। টিকাদান ব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের মধ্যে বড় কোনো অভিযোগ বা অসন্তুষ্টি লক্ষ করা যায়নি। মানুষ আশা করে ছিল, বিশ্বজুড়ে টিকার স্বল্পতা থাকলেও সরকার ঠিক সময়ে টিকা আনতে সক্ষম হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বারবার বলেছেন, টিকার কোনো সংকট হবে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে টিকা সংগ্রহের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রথম ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহ করতে হবে। এর পাশাপাশি প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগও নিতে হবে।