১০টি ডিপোতে বিপিসির অনাপত্তিপত্র ছাড়াই ডিজেলপাম্প স্থাপন। কমবেশি সব ডিপোর অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থায় ঘাটতি।
অনুসন্ধানে অন্তত ১৩টি ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর পানির লাইন) না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএম ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া বিভিন্ন পণ্যের ব্যবস্থাপনার (কনটেইনারে পণ্যবোঝাই) মূল কাজটি হয় বেসরকারি ২০টি ডিপোতে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুণ্ড এলাকার মধ্যে এসব ডিপোর অবস্থান। সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের পর অন্য ডিপোগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে ১০টি কনটেইনার ডিপোর ভেতরে নিজস্ব ডিজেল পাম্প থাকার তথ্য প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার স্থাপনায় ডিজেল পাম্প থাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে কমবেশি সব ডিপোতেই অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। এসব ডিপোর কোনো কোনোটি শর্ত পূরণ না করায় তাদের লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি আটকে আছে। এ ছাড়া বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রতিটি ডিপোতেই কমবেশি ঘাটতি রয়েছে। কাস্টমস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি ও ডিপো সূত্র এসব বিষয় প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ডিপোতে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য ডিজেল পাম্প বসাতে হলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অনাপত্তিপত্র প্রয়োজন। বিপিসি সূত্র বলছে, বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেড, গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেড, মেসার্স এছাক ব্রাদার্স লিমিটেড, পোর্টলিংক লজিস্টিকস সেন্টার লিমিটেড, এসএপিএল (পূর্ব ও পশ্চিম ইউনিট), ওশান কনটেইনার লিমিটেড, কেডিএস লজিস্টিকস লিমিটেড, ইনকনট্রেড লিমিটেড, ইস্পাহানি সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল লিমিটেড ও নেমসান কনটেইনার ডিপো লিমিটেড—এই ১০টি ডিপোতে ডিজেল পাম্প রয়েছে। তবে এসব ডিপোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিয়ে ডিজেল পাম্প বসানো হয়েছে। বিপিসির কাছে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই।
সরেজমিন পরিদর্শন করে ডিপোগুলোতে কী ঘাটতি রয়েছে, তা শনাক্ত করা হচ্ছে। ঘাটতি পূরণের জন্য কী করণীয়, সে নির্দেশনা ডিপোর পরিচালনাকারীদের দেওয়া হবে।মো. ফারুক হোসেন সিকদার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক
এর মধ্যে বিএম ডিপোতে ৪ জুন রাতে আগুন থেকে বিস্ফোরণে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডে ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে গেছে পণ্যবাহী অন্তত ১০০ কনটেইনার। বিএমডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৯ দিন পর ১৩ জুন রাতে পতেঙ্গার ভারটেক্স অফডক লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড নামের আরেকটি ডিপোর ভেতরে তুলার কনটেইনারে আগুন লাগে। অবশ্য ফায়ার সার্ভিস দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনায় বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি নুরূল কাইয়ূম খান প্রথম আলোকে বলেন, অনেকগুলো কমপ্লায়েন্সের (কর্মসহায়ক পরিবেশ) শর্ত মেনে ডিপোগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। এরপরও যে ঘাটতি নেই তা নয়। ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হচ্ছে অনেকগুলো ডিপোতে। বিস্ফোরক অধিদপ্তর লাইসেন্স দেওয়ার কারণেই ডিজেল পাম্প বসানো হয়েছে। এখন যদি নতুন নীতিমালা করা হয়, তাহলে সেই নীতিমালা অনুযায়ী ডিপোগুলো চলবে। আর লাইসেন্সের নবায়নের বিষয়টি একটি ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অন্তত ১৩টি ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর পানির লাইন) না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর অন্যরা ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ শুরু করেছে।
ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকার তালিকায় রয়েছে বিএম কনটেইনার ডিপো, এছাক ব্রাদার্স লিমিটেড, এসএপিএল পূর্ব ও এসএপিএল পশ্চিম, ওশান কনটেইনার লিমিটেড, মেসার্স সিসিটিসিএল (ইউনিট–১ ও ইউনিট–২), ইস্টার্ন লজিস্টিকস লিমিটেড, কিউএনএস কনটেইনার লিমিটেড (ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কাজ চলছে), ছাবের আহম্মেদ টিম্বার কোম্পানি লিমিটেড, মেসার্স শফি মোটরস, পোর্টলিংক লজিস্টকস সেন্টার লিমিটেড (একটি ইউনিটে নেই) ও নেমসান কনটেইনার ডিপো লিমিটেড।
বিএম ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক হোসেন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে ডিপোগুলোতে কী ঘাটতি রয়েছে, তা শনাক্ত করা হচ্ছে। ঘাটতি পূরণের জন্য কী করণীয়, সে নির্দেশনা ডিপোর পরিচালনাকারীদের দেওয়া হবে।
নিয়ম অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবহারের জন্য পাম্প বসাতে হলেও পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে অনুমতি নিতে হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নীতিমালাও প্রণয়নের কাজ চলছে।এ বি এম আজাদ, চেয়ারম্যান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুটি নীতিমালায় থাকা বিভিন্ন শর্ত মানার পর কনটেইনার ডিপো পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। অবশ্য দুটি নীতিমালায় ডিপোর ভেতরে ডিজেল পাম্প বসানো যাবে কি না, তা নিয়ে কিছু বলা নেই। আবার ডিজেল পাম্প বসানো যাবে কি না, সেটি লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা কাস্টমসকে অবহিত করেনি ডিপোগুলো।
বিএম ডিপোত বিস্ফোরণের পর ডিপোতে জ্বালানি তেলের পাম্প থাকার বিষয়টি নজরে আসে দুটি তদন্ত কমিটির। বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে ছিল বিএম ডিপোর ডিজেল পাম্পের অবস্থান। বিএম ডিপোসহ ১০টি ডিপো নিজেদের ব্যবহারের জন্য ডিসপেন্সিং মেশিন (গাড়িতে ডিজেল ভরার ব্যবস্থা) ও স্টোরেজ ট্যাংক (মাটির নিচে যেখানে ডিজেল রাখা হয়) স্থাপন করে ফিলিং স্টেশনের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি ডিপোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন কনটেইনার পরিবহনের যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি দরকার হয়। এ জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিয়েই ডিপোর ভেতরে ডিজেল পাম্প বসানো হয়েছে। এ নিয়ে কোনো সংস্থা আগে আপত্তি করেনি বলেও তাঁরা জানান।
পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিপোতে ডিজেল পাম্প বসানোর জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে কোনো ডিপোই আবেদন করেনি। গত বছর ২২ জুন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কাছে এক চিঠি দেয় বিপিসি। চিঠিতে বিপিসির অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ডিজেল পাম্প বসানোর লাইসেন্স ইস্যু না করতে অনুরোধ করা হয়।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবহারের জন্য পাম্প বসাতে হলেও পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে অনুমতি নিতে হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নীতিমালাও প্রণয়নের কাজ চলছে।
ওই ডিপোগুলো শর্ত পূরণ না করায় লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী, ছাড়পত্র জমা দেওয়ার পরই লাইসেন্স নবায়ন করা হবে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে নীতিমালা অনুযায়ী, এসব ডিপোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।নুরউদ্দিন মিলন, চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র জমা না দেওয়ায় ইস্টার্ন লজিস্টিকস লিমিটেড, এসএপিএল (ইস্ট) ও এসএপিএল (ওয়েস্ট) ডিপোর লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় মেসার্স কেঅ্যান্ডটি লজিস্টিকস ও পোর্টলিংক লজিস্টকস সেন্টার লিমিটেডের (ইউনিট-২) লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। এ ছাড়া মেসার্স সিসিটিসিএল-২, এঙ্কোরেজ ডিপো লিমিটেড ও মেসার্স এছাক ব্রাদার্স লিমিটেডেরও লাইসেন্স এখনো নবায়ন হয়নি।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার নুরউদ্দিন মিলন প্রথম আলোকে বলেন, ওই ডিপোগুলো শর্ত পূরণ না করায় লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী, ছাড়পত্র জমা দেওয়ার পরই লাইসেন্স নবায়ন করা হবে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে নীতিমালা অনুযায়ী, এসব ডিপোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, গত অর্থবছরে রপ্তানি হওয়া ৩৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থাপনা করেছে চট্টগ্রামের ২০টি কনটেইনার ডিপো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান প্রথম আলোকে বলেন, ডিপোর ভেতরে ডিজেল পাম্প রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থেও ডিপোগুলোতে আন্তর্জাতিক মান ও দেশীয় আইন অনুযায়ী কর্মসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার।