রাজধানীর মিরপুরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তির ১৫ হাজার ঘর থেকে মাসে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল ওঠে প্রায় দেড় কোটি টাকা। এই তিনটি সেবা খাতের মধ্যে গ্যাস থেকে সরকার কোনো টাকাই পায় না। আর বিদ্যুৎ ও পানি থেকে খুব সামান্য অর্থ জমা হয় সরকারি কোষাগারে।
বিভিন্ন সেবা সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা মূলত এই টাকা তুলে ভাগাভাগি করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থের ভাগ পান ঢাকা উত্তরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও আওয়ামী লীগের নেতা রজ্জব হোসেন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী ওরফে খোকন। ওয়ার্ডের এই দুই নেতা ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্র অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনে প্রায় ৭০ শতাংশ ঘর পুড়ে যায়। গতকাল রোববার বস্তি এলাকা সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের লাইন নেওয়া হয়েছে। মাটির ওপর দিয়েই প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাস–সংযোগ নেওয়া হয়েছে বস্তির ঘরগুলোতে। আগুন লাগার পর থেকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ মূল পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ চালু আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বস্তিতে ঢুকতেই ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয়। বস্তির একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ঘর নির্মাণ করেছেন ওয়ার্ড কমিশনার ও আওয়ামী লীগের নেতা রজ্জব হোসেন। তবে তাঁর ঘরগুলো আগুনে পোড়েনি। একসময়ের পরিবহনশ্রমিক রজ্জব হোসেন এখন অঢেল সম্পদের মালিক। বস্তি লাগোয়া ১২ তলা তৈরি পোশাক কারখানা, একাধিক বহুতল আবাসিক ভবন এবং একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি।
>শুক্রবার ঝিলপাড় বস্তিতে আগুনে প্রায় ৭০% ঘর পুড়ে যায়
বস্তিবাসীরা গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির টাকা ঠিকই দেন
তবে টাকার খুব সামান্য জমা পড়ে সরকারি কোষাগারে
জানতে চাইলে রজ্জব হোসেন টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্তিসংলগ্ন আমার ১২ তলা একটি গার্মেন্টস কারখানা আছে, এটা সত্য। তবে বস্তিতে আমার ঘর নেই। বস্তি থেকে চাঁদা তোলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এসব মিথ্যা অভিযোগ।’
বস্তিতে ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলীরও বেশ কিছু ঘর রয়েছে। তবে প্রথম আলোর কাছে বস্তিতে ঘর থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। বস্তি থেকে সহযোগীদের মাধ্যমে টাকা তোলার অভিযোগের বিষয়ে গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে শওকত আলী বলেন, ‘আমি চাঁদা তোলার সঙ্গে যুক্ত নই। এসব অভিযোগ মিথ্যা।’
গ্যাস–সংযোগ পুরোটাই অবৈধ
বস্তির ১৫ হাজার পরিবারই অবৈধ গ্যাস–সংযোগ নিয়েছিল। প্রতি বাসা থেকে গ্যাসের জন্য নেওয়া হয় ৫০০ টাকা, মাসে তা ৭৫ লাখ টাকা। এসব অর্থ তিতাসের হিসাবে জমা হয় না, চলে যায় সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের পকেটে।
একাধিক বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তিতে নতুন গ্যাস–সংযোগ ও মাসিক বিল সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন জিতু, মোন্তাজ ও দুলাল নামে তিন ব্যক্তি।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মিরপুর জোনের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছয় দিন আগে এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। কারা অবৈধ সংযোগ দিয়েছেন, তা তাঁর জানা নেই।
প্রকাশ্যে চোরাই গ্যাস দিনের পর দিন ব্যবহার হলেও তিতাসের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা তা জানেন না কেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঝিলপাড় অনেক বড় একটি বস্তি। সেটির নিয়ন্ত্রণে থাকেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সবকিছু তিতাসের লোকদের হাতেও থাকে না। তবে নিচু পর্যায়ের কিছু লোক হয়তো জড়িত থাকতে পারেন। এ বিষয়ে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা গেলে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
প্রসঙ্গত, তিতাস এলাকায় ১২ শতাংশ সিস্টেম লস হচ্ছে এখন। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, সিস্টেম লস বলে তিতাসে কিছু নেই। আসলে পুরোটাই চুরি। তিতাস গ্যাস এলাকায় প্রতি মাসে চুরি যাওয়া গ্যাসের মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা, বছরে যা প্রায় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার মতো।
পানির বিল ভাগাভাগি
বস্তির বাসিন্দা নুরুন্নাহারের ঘর পোড়েনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পানি আসে। প্লাস্টিকের পাইপলাইন দিয়ে পানি সরবরাহ করা হয় প্রতিটি বাসায়। পানির জন্য দিতে হয় মাসে ১০০ টাকা। তবে এখানে পানির অনেক কষ্ট বলে তিনি জানান। দিনের সব সময় পানি পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, ১৫ হাজার বাসিন্দার কাছ থেকে পানি বাবদ ১৫ লাখ টাকা তোলে সরকারি দলের সিন্ডিকেটটি। এ অর্থের পুরোটা তারা ঢাকা ওয়াসার কাছে জমা দেয় না। এটাও ভাগাভাগি হয়।
বিদ্যুৎ বিল ৫৫ লাখ, ডেসকো পায় ৫ লাখ
বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য প্রতিটি ঘরের বাসিন্দাকে দিতে হয় ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা। একাধিক ফ্যান, বাতি, টিভি এবং ফ্রিজ ব্যবহারের জন্য দিতে হয় মাসে ১ হাজার টাকা। এ রকম পরিবার প্রায় ১০ শতাংশ, তাদের কাছ থেকে আসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। দুটি বাতি, একটি ফ্যান ও একটি টিভি থাকলে মাসে ৩০০ টাকা দিতে হয়। এ রকম ৯০ শতাংশ পরিবারের কাছ থেকে অন্তত ৪০ লাখ টাকা তোলা হয়। প্রতি মাসে বিদ্যুতের বিল সব মিলিয়ে ওঠে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা।
বস্তিবাসীদের বৈধভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ দিতে সরকারের সিদ্ধান্তে পোল মিটার বসানো হয়েছে। বস্তিতে ঢোকার মুখে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) একটি পোল মিটার ও ট্রান্সফরমার রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এই মিটার থেকে বস্তির প্রতিটি ঘরে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বৈধ সংযোগ নেওয়ার কথা। বস্তিতে স্থায়ী ১৬০০ ভোটার রয়েছেন। তবে পোল মিটার থেকে নেওয়া মিটারের সংখ্যা মাত্র কয়েকটি।
ডেসকোর মিরপুর জোনের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, মাত্র কয়েকটি মিটার দিয়ে বস্তিতে ১৫ হাজার ঘরে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া অবৈধ বলেও স্বীকার করেন তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেন, বস্তির বিদ্যুৎ সরবরাহে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় ডেসকো সেখানে অভিযান চালাতে পারে না। তারা শুধু পোল মিটারে যে বিদ্যুতের বিল আসে সেটি গ্রহণ করে। এর পরিমাণ ৫ লাখ টাকার নিচে।
শফিকুর রহমান নামে বস্তির একজন বাসিন্দা বলেন, তিনি বিদ্যুতের জন্য প্রতি মাসে ৩০০ টাকা দেন ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে। যিনি ‘টাইটেল ফারুক’ নামে পরিচিত। গ্যাসের ৫০০ টাকা নেন দুলাল নামে একজন।
সরেজমিনে জানা গেছে, বিল নিতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা যান না। এই বিল ব্যাংকেও পরিশোধ করা হয় না। বিল দিতে হয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলীর অনুসারীদের কাছে। তাঁরা হলেন মল্লিক, টাইটেল ফারুক, শামসু ও মল্লিক বাচ্চু। নতুন সংযোগ নিতে হলেও যেতে হয় তাঁদের কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেসকোর মিরপুর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শাহ সুলতান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্তির মুখেই একটি পোল মিটার ছিল। মিটারে যতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় আমরা সেই বিলটি পাই। কিন্তু পোল মিটার থেকে কারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, তারা কাকে অর্থ দেয়, তা আমাদের জানা নেই। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে কর্মীদের নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে।’