ঝিনাইদহ, মৌলভীবাজার ও ঢাকা আঞ্চলিক উৎসব

ঝড় বা খরতাপ, উৎসব হবেই

ঢাকা অঞ্চল : ঢাকায় বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন
ঢাকা অঞ্চল : ঢাকায় বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন

বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনিতে ঘুম ভাঙল। সকাল ৬টা ৪৫ মিনিট। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দেখি মহুয়াগাছের ডাল আছড়ে পড়ছে আমাদের আশ্রয়স্থলের দেয়ালে। এমনিতে এপ্রিলের গরম, কিন্তু থেকে থেকে বৃষ্টি আর বাতাসে শরীরে কাঁপন ধরেছে। আর মনে? রাজ্যের বিষাদ। ভাষা প্রতিযোগ ২০১৭-এর ঝিনাইদহ আঞ্চলিক উৎসব চোখের সামনে পণ্ড হয়ে যাচ্ছে।
আগের দিন শুক্রবার খুলনায় আঞ্চলিক উৎসব করে এসেছি প্রচণ্ড গরমের মধ্যে। অনুষ্ঠানে কোনো অসুবিধা হয়নি। সন্ধ্যায় মাইক্রোবাসে যশোর পেরোতে গিয়ে শুরু হলো বৃষ্টি। তখনই উদ্বেগের শুরু। ঝিনাইদহ পৌঁছাতেই বেজে গেছে রাত ১০টা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, অফিসের সহকর্মী আর প্রথম আলো বন্ধুসভার কর্মীদের একটি রেস্টহাউসে তুলে দিয়ে গেলাম ঝিনাইদহ শহরের ওয়াজির আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মাঠের কোথাও ঘাস চোখে পড়ে, কোথাও পড়ে না। কেন? সকালবেলা পানি, শুধু পানি।
মঞ্চ আর প্যান্ডেলের কাজ তখনো ৭০ শতাংশই বাকি। ডেকোরেটর আশ্বস্ত করতে চাইলেন, রাতের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।

মৌলভীবাজার: এক কক্ষে পরীক্ষা দিয়েছে ২৩২ জন শিক্ষার্থী

কিন্তু সকাল হতে না হতেই ঝড়, তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। কীভাবে হবে এই আঞ্চলিক উৎসব? সকাল আটটার দিকে থেমে গেল বৃষ্টি। মাঠ থেকে খবর এল, অনেক শিক্ষার্থী একা, অনেকে মায়েদের হাত ধরে পৌঁছে গেছে স্কুলের মাঠে। দৌড়ে গিয়ে দেখি মাঠে, প্যান্ডেলের নিচে পাঁচ শতাধিক ছেলেমেয়ে। নানা স্কুলের পোশাকে ওদের অপূর্ব লাগছে। কেউ কেউ বেশ ভিজেছে, তবে নিচের দিকে বেশির ভাগই ভেজা।
দু-একজনের সঙ্গে কথা বললাম। চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা সাদমান সাকিবের মা বললেন, তিনি ছেলেকে বোঝাতে চেয়েছেন, এই ঝড়–বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু সাদমান আসবেই। রাস্তায় বেরিয়ে কোথাও কোনো যানবাহন পাননি। পরে একজন মোটরসাইকেলের আরোহীকে থামিয়ে বললেন, তঁারা ঝিনাইদহ আসতে পারছেন না। ভদ্রলোক অর্ধেক পথ আসবেন, সেটুকু মা ছেলেকে নিয়ে এলেন মোটরসাইকেলে করে। সেখান থেকে আরেকটা গাড়ি ধরে এলেন ঝিনাইদহ।

ঝিনাইদহ উৎসবে ঝড় ও বৃষ্টি আনন্দে বাধা হতে পারেনি


ঝিনাইদহ আঞ্চলিক উৎসব মানে ঝিনাইদহ শুধু নয়, আশপাশের জেলাগুলোর শিক্ষার্থীরাও এ উৎসবে আমন্ত্রিত। তারা রেজিস্ট্রেশন করেছে। দেখতে দেখতে ছয়-সাত শ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে উৎসব প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ। জামা-প্যান্ট ভেজা, জুতোর ভেতরে ঢুকে গেছে কাদা। চেয়ারে বসলেও পায়ের নিচে তখনো পানি। কিছুই এ উৎসবকে ঠেকাতে পারেনি। আমরা আনন্দিত, বিস্মিত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, যিনি আসেন কুষ্টিয়া থেকে, তিনিও এলেন প্রায় যথাসময়ে।
বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান হলো। জাতীয় সংগীত, উদ্বোধন, পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর পর্ব, গান, বানান-বীর প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ—প্রতিটি পর্বই হলো প্রাণবন্ত।
পরে মৌলভীবাজার বা ঢাকার আঞ্চলিক উৎসব—সব ক্ষেত্রেই দেখেছি, এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগের ব্যাপারে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ। কোথাও শিক্ষার্থীর আগ্রহ বেশি, কোথাও অভিভাবকদের। দূর–দূরান্ত থেকে কত কষ্ট করে যে সকাল আটটায় তাঁরা হাজির হন, তা লিখে বোঝানো যায় না। আঞ্চলিক উৎসব হয় পাঁচ-ছয়টা জেলা নিয়ে একটি জেলা শহরে। অন্য জেলাগুলো থেকে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটাই কথা, তাঁদের জেলায় হয় না কেন? আমরা বলি, ধরা যাক এবার মৌলভীবাজার হলো, আগামীবার হবিগঞ্জে হবে। পরেরবার সিলেটে। এভাবে অনুষ্ঠান ঘুরতে থাকবে।

মৌলভীবাজার অঞ্চল : উদ্বোধনী পর্ব

ঝিনাইদহের কথা বেশি লিখলাম, কারণ এখানে অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত হবে না বলেই ধরে নিয়েছিলাম। ভাষা প্রতিযোগের প্রতি আগ্রহ আমাদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছে। মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজে মৌলভীবাজার আঞ্চলিক উৎসব কী সুন্দরই না হলো! ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঢাকা আঞ্চলিক উৎসব আরও বর্ণময়। কারণ, এ উৎসবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
১৩ বছর ধরে ভাষা প্রতিযোগ হচ্ছে। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে, উত্তর দেন প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষকেরা। এমন অনেক প্রশ্ন করা হয়, যেসব প্রশ্নে শিক্ষকদেরও মাঝেমধ্যে নড়েচড়ে বসতে হয়। এমন প্রশ্নও আসে, যেগুলো শুধু ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কেন অনেকে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, কেন বাংলা সাইনবোর্ডে এত ভুল, কেন আমরা নিরন্তর প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজি নামে রাখি, যেখানে সুন্দর বিকল্প বাংলা রয়েছে? এ প্রশ্নগুলো ঝিনাইদহ, মৌলভীবাজার, ঢাকা বা যেকোনো অঞ্চলেই করা হয়।
স্থানীয় ভাষায় গান, কবিতা উৎসবগুলোকে আরও মুখর করে তোলে। মৌলভীবাজারে সিলেটের ভাষায় গান আর ঢাকায় আদি ঢাকাইয়া ভাষায় কথাবার্তা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আনন্দিত ও উৎসাহিত করে। সে দুটো কথা আমরা মনে রাখি, যা লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ‘বাংলা ভাষায় কাঁদি হাসি/সকল ভাষা ভালোবাসি।’

ঝিনাইদহ অঞ্চল : উদ্বোধনের অপেক্ষায়