ভালোবাসার শহর ছবিতে জয়া আহসান
ভালোবাসার শহর ছবিতে জয়া আহসান

জয়া আহসানের মুনশিয়ানা

জয়া আহসান আজকের দুই বাংলায় ক্যারিয়ারের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছেন—এটি আশ্চর্য না হলেও আশাদায়ী ঘটনা।

সদ্য প্রসূত একটি শিশুকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বেডে এক মা, নাক-মুখ বেয়ে ঝরছে পানি, কান্নাজড়ানো অদ্ভুত আনন্দমাখা একটা মুখ। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মেয়ের শরীর পরিষ্কার করছে মা, মলিন-নির্জীব একটা চেহারা—মেঘ থমথমে নির্বিকার একটা মুখ। রাস্তার পাশে ফুটপাতে গায়ের সব শক্তি দিয়ে বমি করছে একটা মেয়ে, তারপর চোখে-মুখে পানি ঢেলে বসে আছে চায়ের দোকানে—এক শহর ব্যথা থমকে থাকা একটা মুখ। অসুস্থ মেয়েকে আদর করতে করতে বুকে চেপে দম আটকে মেরে হত্যা করছে মা—চোখে ঠিকরে পড়ছে আগুন, যেন বিধাতার অবিচারের প্রতিশোধ নিচ্ছে। পশ্চিম বাংলার নির্মাতা ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর ভালোবাসার শহর-এ অভিনেত্রী জয়া আহসানকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কথাগুলো।

আমেরিকান নির্মাতা ড্যারেন আরোনফস্কির সাইকোলজিক্যাল হরর ছবি ব্ল্যাক সোয়ান দেখতে দেখতে প্রশ্নটা মনে জেগেছিল, ঢাকায় কে হতে পারেন নাতালি পোর্টম্যানের এই চরিত্রের বিকল্প? কেট উইন্সলেটের রিডার দেখেও মনে এসেছিল কথাটা। ইসাবেল হুপার্টের হোয়াইট ম্যাটারিয়াল দেখেও ভেবেছিলাম। কোনো ছবিতে ভালো একটা চরিত্র দেখলে প্রথমেই মাথায় আসে এই জিজ্ঞাসা, আমাদের এখানে কে করতে পারে এই চরিত্র? এক দশকের নির্মাণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখানে চরিত্রে মানানসই অভিনেতা-অভিনেত্রী পাওয়াটা ছবির টাকা জোগাড় করার চেয়েও কঠিন। ইংরেজিতে যাকে বলে সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ বা পর্দাকে অবিশ্বাস করার মগজের যে প্রক্রিয়া, সেটা বন্ধ করে দিতে পারে—এই অভিনয় আমরা প্রায় পাই-ই না এখানে। তাঁর মূল একটা কারণ সম্ভবত চরিত্রায়ণের সংকট। সবাই নাটকীয় ‘অভিনয়’টা কমবেশি করেন—চরিত্রটা ধারণ প্রায় কেউই করেন না। চরিত্রগুলো যে নিজেদের তারকা পরিচয়ের বাইরে পর্দার পরিচয় নিতে পারে না, এর কারণও সম্ভবত আধুনিক অভিনয়কলায় সিনেমার চরিত্রায়ণ বোঝা এবং পড়ার অভাব—জয়া আহসানের মুনশিয়ানাটা সম্ভবত এখানেই।

মডেলিং-টেলিভিশন মিলে জয়ার ক্যারিয়ার দুই দশকের, কিন্তু পূর্ণমাত্রায় একজন অভিনেত্রী জয়া আহসানকে আমরা প্রথম দেখতে পাই ২০১০ সালে নুরুল আলম আতিকের ডুবসাঁতার ছবিতে। যদিও তার আগে ২০০৩ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি ব্যাচেলর-এ ডজনখানেক নায়ক-নায়িকার মাঝখানে জয়ার একটা স্টেরিওটাইপড উপস্থিতি ছিল। সেটিকে জয়া নিজেই বলেছেন ‘ক্যামিও’। কিন্তু ডুবসাঁতার-এর পর ২০১১-তে জয়াকে বৃহত্তর দর্শকের কাছে হাজির করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ তাঁর গেরিলা ছবিতে। তারপর ২০২১-এ অলাতচক্র পর্যন্ত এই ১০ বছরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী জয়া বাংলাদেশের দশটা ছবিতে দশ রকম চরিত্রে কাজ করেছেন, যেখানে শাকিব খানের সঙ্গে অভিনীত রগরগে বাণিজ্যিক ছবি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী থেকে শুরু করে আকরাম খানের স্লো আর্ট-হাউস ছবি খাঁচাও ছিল আবার তাঁর নিজের প্রযোজিত ছবি দেবীর মতো সফল ছবিও ছিল।

একজন নির্মাতা হিসেবে সমসাময়িক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটার প্রতি মনোযোগী থাকার চেষ্টা করি, একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থেই। লক্ষ করলাম, ডুবসাঁতার দিয়ে যে সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী পর্দায় এসেছিলেন, আমাদের ছবির মন্দা বাজার তাঁকে শুধু ‘অবজেক্টিফাই’ করে একজন তারকার জন্ম দিয়েছে। যদিও জয়াই এর প্রথম শিকার নন। মস্কো তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে আসা বার্লিনে বিয়ারজয়ী অশনি সংকেত-এর অনঙ্গ বউ ববিতাকে আমরা পরে আর ‘চরিত্রে’ পাইনি। এরপর ঢাকার রাস্তায় ববিতা রিকশাও চালিয়েছেন জর্জেটের শাড়ি পরে। তিতাস একটি নদীর নাম-এর ‘রাজার ঝি’ কবরীকেও আমরা পরে হারিয়েছি। এরপরের কবরী শুধুই তারকা আর চরিত্রহীন চরিত্রদের পুনরুৎপাদনের গল্প।

এখানেও একটা নতুন ঘটনার জন্ম দিলেন জয়া। ২০১৩ সালে অরিন্দম শীলের আবর্ত দিয়ে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত মাত্র ছয় বছরে অতনু ঘোষ, শিবপ্রসাদ রায়, কৌশিক গাঙ্গুলী, সৃজিত মুখার্জি, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীসহ সমসাময়িক কলকাতার আলোচিত প্রায় সব নির্মাতার ছবিতেই কাজ করেছেন জয়া—প্রতিটা ভিন্নমাত্রার আলাদা চরিত্রে।

এই উপমহাদেশের অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গ এলে আমার প্রায়ই বিনোদিনীর কথা খুব মনে পড়ে। নটী বিনোদিনী ১২ বছর বয়সে শুরু করে মাত্র ২২-২৩ বছর বয়সে মঞ্চ ছেড়ে চলে যান, যার ইতিহাসবৃত্তান্ত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক রাজধানী ‘আলোকিত’ কলকাতার অন্ধকার দিকের গল্পই বলে। এমনকি পশ্চিম বাংলার আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন যে বয়সে অভিনয় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রায় কাছাকাছি সময়ে জয়া আহসান আজকের দুই বাংলায় ক্যারিয়ারের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছেন—এটি একটা আশ্চর্য না হলেও আশাদায়ী ঘটনা। আশ্চর্য নয় এই জন্য যে শিল্পীর কোনো বয়স নেই, আশাদায়ী এই জন্য যে এটি একটা দুর্লভ ভবিষ্যতের হাতছানি দিচ্ছে—যেখানে অনঙ্গ বউ বা রাজার ঝিরা পৌঁছাতে পারেননি।

ফরাসি চলচ্চিত্রে যাঁকে লিভিং মাস্টার বলা হয়ে থাকে, সেই ক্লেয়ার দেনিকে একবার তাঁর হোয়াইট ম্যাটারিয়াল ছবিটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, ইসাবেল হুপার্টকে কেন নিয়েছিলেন তাঁর সে ছবিতে। ২০০৯ সালে হোয়াইট ম্যাটারিয়াল যখন মুক্তি পায়, হুপার্টের বয়স তখন ৫৬। দেনির উত্তরটা এখনো কানে লেগে আছে, ‘হুপার্টের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ওর অভিনয়, ওর চরিত্রায়ণ অবিশ্বাস্য রকম বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে। আমি তাই ওকে মাথায় রেখেই চিত্রনাট্যটা করেছিলাম।’

আমুর ছবিটা দেখে ঘুমাতে পারিনি সারা রাত। ভোররাত পর্যন্ত জেগে পরপর দুবার দেখেছিলাম ছবিটা। জটিল মনস্তাত্ত্বিক সব ছবির নির্মাতা মাইকেল হানেকের বানানো ফরাসি ছবি আমুর, ৮০ বছরোর্ধ্ব এক সুখী দম্পতির অসুখের ছবি আমুর; আমুর মানে ভালোবাসা। ২০১২ সালের ছবিতে আনের চরিত্রে ৮৫ বছর বয়সী ইমানুয়েল রিভা, আর ৮২ বছর বয়সী জর্জের চরিত্রে জঁ লুই তান্তিনিওর চরিত্রায়ণ দেখে বোকা হয়ে গিয়েছিলাম—মনে হয়েছিল শুধু এদের দুজনের জন্যই এ ছবিটা বানানো যায়। লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, এই ছবিতেও একটা ছোট্ট চরিত্রে আনের মেয়ে হয়েছিলেন ইসাবেল হুপার্ট—তাঁর তারকাখ্যাতি তাতে কোনো বাধা হয়নি।

একটু দেরিতে হলেও রাজকাহিনীর রুবিনার মতো একটা ছোট চরিত্র থেকে মাত্র কয়েক বছরে দুই বাংলার অন্যতম প্রধান অভিনেত্রীতে জয়ার রূপান্তর তাই একটা অনন্য ভবিষ্যতেরও লোভ দেখাচ্ছে—বলছে দুই বাংলায় নতুন এক কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা।

কলকাতা একটা প্রাদেশিক রাজধানী। এর জন্ম হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকের ইচ্ছায়—মূলত তাদের খেদমতেই। স্বাধীন ভারতেও কলকাতার সেই চাপ খুব একটা কমেনি। মুখটা শুধু ঘুরে গেছে মুম্বাই আর দিল্লির দিকে। সেই দিক থেকে ঢাকা একটা অনন্য ঘটনা—একটা রাষ্ট্রের কেন্দ্র, স্বাধীন বাংলার রাজধানী, ইতিহাসে যাকে লড়াই করে পুনর্জন্ম নিতে হয়েছে বারবার। কলকাতা যেখানে সব সময়ই কমবেশি একটা নিরাপদ আশ্রয়ে বেড়েছে, দিল্লি-মুম্বাইয়ের ছায়ায় থেকেছে—সেখানে ঢাকার অর্গানিক জন্মপ্রক্রিয়া প্রায় হাজার বছরের, বেড়ে ওঠা সুবে বাংলায়, আর বায়ান্ন-একাত্তর একে দিয়েছে বর্তমানের এক অপ্রতিরোধ্য চেহারা। নগরের এই ছাপচিত্র বা জেনেটিক্যাল ইমপ্রিন্ট আর তার উত্তরাধিকার নাগরিক চিন্তায় ছাপ ফেলে—শিল্প-সংস্কৃতিতে এর প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি।

কলকাতার একের পর এক মেথডিক্যাল প্রযোজনা হিংসা করার মতো। এর বিপরীতে ঢাকার স্বল্প কাজও অনেক বেশি দুঃসাহসী, বেপরোয়া আর আশাবাদী। গত এক দশকে কলকাতা অনেক ব্র্যান্ডেড নির্মাতা তৈরি করেছে, এটা তাদের অনেক দিনের শিল্প-সংস্কৃতি কারখানা ও ব্যবস্থাপনার ফসল। কিন্তু গত এক দশকে একাত্তর–পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে নতুন চিন্তার এক ধারা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে—যার প্রথম সারিতেই আছে স্বাধীন চলচ্চিত্র। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে গর্ব করার মতো নতুন অনেক প্রাপ্তি নিয়মিত যুক্ত হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রে। এ যাত্রায় অনেকের মধ্যে জয়া আহসান এক অনন্য দিশারি।

জয়া আহসান কী করেছেন, সেটা আমরা দেখেছি; কিন্তু আমার ধারণা, জয়ার শ্রেষ্ঠ যে কাজটা এখনো হয়নি—সেটা তাঁর আপন জন্মভূমিতেই হবে। সেখানে অবশ্য জয়ার চেয়ে দর্শক-নির্মাতা হিসেবে আমাদের দায়টাই বেশি।


কামার আহমাদ সাইমন: চলচ্চিত্রকার