বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বেশ উচ্চারিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি সরব। তবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সজীব ওয়াজেদ জয় ঠিক কী দায়িত্ব পালন করবেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন দলটির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য গত বুধবার প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘জয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দলীয়ভাবে আমাদের কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। সুতরাং তাঁর কর্মকাণ্ড বলি, আর চমকের কথা বলি, সে বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।’
আর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বলেছেন, ‘তিনি (জয়) একজন শিক্ষানবিশ রাজনীতিবিদ। তাঁকে শেখার জন্য আরও সময় দিতে হবে। যাঁর শরীরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রক্ত, তিনি ভালো কিছু করবেন—এটা আমাদের বিশ্বাস।’
এদিকে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও দলীয় ইশতেহারে তরুণ ভোটারদের বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ, নির্বাচনী প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে জয় চমক দেখাবেন বলে মনে করেন দলের তরুণ নেতা-কর্মীরা।
এ বছর ১২ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সজীব ওয়াজেদ বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষ চমক পছন্দ করে। এবার চমক দেখানো হবে।’ পরে অবশ্য তিনি চমকের কথা অস্বীকার করেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করেন, রাজনীতিতে সফল হতে হলে জয়কে স্থায়ীভাবে দেশে অবস্থান করতে হবে। ‘ক্লিন ইমেজ’ অধিকারী জয়কে চমক দেখাতে কথা বলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘জয় কী চমক দেখাতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনাকেই জয় সাহেব চমক হিসেবে ব্যবহার করছেন।’
জয়ের কর্মকাণ্ড: আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও সজীব ওয়াজেদ জয়কে জনসমক্ষে দেখা গেছে কমই।মেয়াদের প্রায় শেষদিকে তিনি সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন।জানা যায়, জয় নির্বাচনের প্রচার কৌশল ঠিক করবেন।সে জন্য তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বলেও কয়েকটি পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল। তিনি দেশে আসার পরপরই আলোচনায় আসেন ২৫ জুলাই যুবলীগের এক ইফতার মাহফিলে যোগ দিয়ে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে।’ আর গোটা রাজধানীতে বিভিন্ন আকৃতির বিলবোর্ড টাঙানো নিয়ে সমালোচনার মুখে সাংবাদিকদের জয় জানান, বিলবোর্ডের পরিকল্পনা তাঁর মাথা থেকে বেরিয়েছে।এবার দেশে এসে তিনি রংপুর, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ সফর করেছেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ফেসবুক, টুইটারে মন্তব্য করছেন।
আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জয় যেন সহজেই চমক দেখাতে পারেন, সে জন্য তাঁকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছে।
জানা গেছে, জয় দেশে আসতে শুরু করায় দলের নেতা-কর্মীরা খুশি। ময়মনসিংহ সফরে জয়কে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার। তিনি বলেন, সজীব ওয়াজেদ বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন মাত্রা। তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগ আরও অনেক দূর যাবে। যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহি প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, সজীব ওয়াজেদ দেশের যুবসমাজকে নিয়ে মতবিনিময়, খোলামেলা আলোচনা করছেন, এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভাবধারার সূচনা করেছে। জয়ের মতো স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কেউ রাজনীতিতে এলে বাংলাদেশ বিশ্বায়নের পৃথিবীতে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।
অনেকে বিরোধীদলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে জয়ের তুলনা করেছেন। অনেকের কাছে জয়ের ভাবমূর্তি অনেকাংশে তারেকের চেয়ে ভালো। তিনি ফেসবুক, টুইটারে নিয়মিত স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, সেটিও কারও কারও মতে খুব ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।
অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কিছু সমালোচনাও আছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলা আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন সজীব ওয়াজেদ। আর ১৯৮৮ সালে বগুড়ার গাবতলী থেকে প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন তারেক রহমান। তারেক রহমান বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হয়েছেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত গিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের আস্থা অর্জন করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জয় এখনো রাজনীতিতে পরিপক্ব নন। তাঁর বাংলা উচ্চারণও বাংলাদেশিদের মতো নয়। তা ছাড়া তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। মাঝেমধ্যে দেশে আসেন৷ নীরবে এসে নীরবেই চলে যান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘সজীব ওয়াজেদ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ মানুষ। তার নিজের ভেতরকার এই “চমক” মানুষকে দেখাতে হবে। তবে বিদেশে অবস্থান না করে দেশে থাকতে হবে। অন্যদের তুলনায় তাঁকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে।’
যাঁরা রাজনীতির ময়দানে নবাগত সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেখতে গেছেন তাঁদের কেউ কেউ ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে জনসংযোগের বিষয়টি পছন্দ করেননি। অনেকে বলেছেন, জয়কে তাঁর মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো সবাইকে আপন করে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে। কালো চশমা পরে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস বদলানোরও আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে।
ফেসবুক বা টুইটারে বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগের ব্যাপারেও নানা মত আছে। ফেসবুকে জয়ের পেজে লাইক দেওয়া মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ১৩ হাজার ৫০৬ জন (৯ অক্টোবর)। আর টুইটারে জয়ের অনুসারী (ফলোয়ার) প্রায় আড়াই হাজার। ফলে মোট ভোটারের খুব সামান্য একটি অংশের কাছে জয় পৌঁছাতে পারছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
জয়কে নিয়ে বাবা ড. ওয়াজেদ মিঞার মূল্যায়ন: ২০০৪ সালে সজীব ওয়াজেদ সস্ত্রীক দেশে ফেরার পর তত্কালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। তবে জয় শুভেচ্ছা বার্তা গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেন। এরপরই জয় সম্পর্কে ২৪ ডিসেম্বর জয়ের বাবা ড. ওয়াজেদ মিঞা একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারেক আর জয়ের ক্ষেত্রে এটা হওয়া উচিত নয়। তাদের দুজনের তো কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিরোধ নেই। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। জয়ের হঠাত্ হঠাত্ রেগে কথা বলা, অস্থির প্রবণতা এবং অতি আত্মবিশ্বাস বাদ দিতে হবে। তাহলে জয় অবশ্যই সাফল্য পাবে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামানীষ শেখর, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি কামরান পারভেজ।)