‘পদ্মা জেনারেলে নেওয়ার পাঁচ মিনিট পরই রোগীরে সিজারের জন্য নিয়া গেছে। কে ডাক্তার, তা-ও জানি না। তারপর শুনি ক্লিনিকের সবাই পালাই গেছে। রোগী কি মারা গেছে, সেলাই দিছে কি না, কী খবর, কিছুই জানি না। ভেতরে রোগী রাইখ্যা তালা দিয়া পালাই গেছে। ভালো ডাক্তার হইলে তো পালাইত না। আমি কঠিন বিচার চাই। আমরা তো গরিব মানুষ। কেন করল এমন?’
ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন মো. তানভীর। তিনি সদ্য ছেলের মা হওয়া ইতি আক্তারের স্বামী। এই মা আলোচনায় এসেছেন গত রোববার নারায়ণগঞ্জের একটি নিবন্ধনহীন ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে প্রাণসংশয় হওয়ার মতো ঝুঁকিতে পড়ার মধ্য দিয়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধনহীন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধের অভিযান চলছিল সারা দেশে। এই অভিযান হতে পারে, সেই ভয় থেকে ইতি আক্তারকে অস্ত্রোপচারের টেবিলে রেখে পালিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামের ক্লিনিকের কর্মীরা।
খবর পেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) মাহমুদুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ইতি আক্তারসহ অন্য মায়েদের উদ্ধার করেন। তারপর ইতি আক্তারসহ অন্যান্য মা ও তাঁদের নবজাতকদের মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
আজ মঙ্গলবার সকালে শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে গিয়ে কথা হয় তানভীরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন বাচ্চা সুস্থ, বাচ্চার মা সমস্যার মধ্যে আছে। ওই দিন কাটছে (অস্ত্রোপচার) অথচ বাচ্চার মা সব বলতে পারে, ব্যথা পাইছে। এই কথা বলনের পর অপারেশনের মধ্যে তারে আবার অবশ করে।’
ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তানভীর বলেন, সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে গেলে তিনি তাঁদের বলেন, ‘ভাই আমারে একটু সাহায্য করেন। অস্ত্রোপচার রুমের এক দিকের দরজায় তালা লাগানো ছিল। আরেক দিকে কাচের একটি দরজা ধাক্কা দিতে বলেন সাংবাদিকেরা (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্ধারকারীরাও হতে পারেন)। তখন তানভীর তা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে গিয়ে দেখেন, তাঁর স্ত্রী শুয়ে আছেন, তখনো প্রায় অজ্ঞান হয়ে আছেন। তানভীর জানান, ঘটনার আগেই ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ক্লিনিকে জমা দিয়েছিলেন, রোগী ভালো হলে মোট ১৮ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল।
আজ মাতুয়াইলের হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন ইতি আক্তার। তখন তাঁর বুকে ব্যথা হচ্ছিল। অস্ত্রোপচারের পর সেলাইয়ের জায়গাতেও ব্যথা আছে। ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না। কোলে নিতে গেলেই ব্যথায় কাতরাতে থাকেন।
শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানালেন, ইতি আক্তারের ছেলে ভালো আছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দিতে হয়নি।
ওই দিনের ঘটনায় পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল থেকে উদ্ধার হওয়া আরেক নবজাতকের মা নূরজাহান বেগমকেও শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। পদ্মা জেনারেলে এই মায়ের অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসব হয়েছিল ওই ঘটনার আগের দিন শনিবার। নূরজাহানের মতে, পদ্মা জেনারেলকে ক্লিনিক না বলে কসাইখানা বলা উচিত। জানালেন, সেলাইয়ের জায়গায় ব্যথায় চিৎকার করলেও কোনো চিকিৎসক বা নার্সের দেখা পাননি। এই মা-ও অভিযোগ করলেন, তাঁকে অবশ করে অস্ত্রোপচার করা শুরু করলেও তিনি ব্যথা পাচ্ছিলেন, সব বুঝতে পারছিলেন। ওই কথা জানানোর পর আবার তাঁকে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
নূরজাহান বেগম ঘটনার দিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘খুব ভয় পাইছি। আল্লাহ এইটা কী হইল। ক্লিনিকে নিজের সুবিধার জন্য গেছি। ওইখানে খালি সিজার হয়, আর কিছু হয় না। টাকাপয়সা জমা দেওয়া না হইলে চইলা আসতাম। সবাই পালানোর পর দেখি, আমাদের চিকিৎসার ফাইলপত্রও নিয়া চইল্যা গেছে, কিছুই সঙ্গে আনতে পারি নাই।’
ইতির বয়স কত, জানতে চাইলে পাশ থেকে তাঁর মা নাজমা আক্তার জানালেন, ১৮ বছর হবে। বিয়ের এক বছরের মাথায় ইতি সন্তানের মা হয়েছেন। ওই দিনের ঘটনা জানতে চাইলে ইতির মুখে দেখা দেয় কষ্টের হাসির রেখা। বললেন, ‘সবাই ঢুকল তালা ভাইঙ্গা। জ্ঞান ফিরলে শুনি হেরা আমারে লক কইরা থুইয়া গেছে। সিজার করবার নিছে, সুই দিছে, আর তো কিছু বলতে পারি না। ছেলে হওনের পর একজন ছেলের মুখ দেখাইছিল। লক করা অবস্থায় রুমে ক্লিনিকের আর দুইজন মহিলা ছিল, তাদের কাছে বাচ্চা কেমন আছে, তা জানতে চাই। পরে দেখি, সবাই আমার ছবি তুলতাছে।’
তানভীর ও ইতি পড়াশোনা করেননি। ইতির বাড়ি নেত্রকোনায় আর তানভীরের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের সিআর খোলা নামের একটি জায়গায় ভাড়া বাসায় তাঁরা থাকেন। তানভীর একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। পদ্মা জেনারেলের যিনি অস্ত্রোপচার করেছেন, তাঁর নাম জানেন না, এমনকি যে নারী বা দালাল ওই ক্লিনিকে তাঁর স্ত্রীকে নিতে বলেছিলেন, তাঁরও নাম জানেন না তিনি।
ইতি আক্তারের সঙ্গে হাসপাতালে তাঁর মা নাজমা আক্তার, ইতির নানি মনোয়ারা খাতুনসহ অন্য স্বজনেরা আছেন। বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রয়েছেন স্বজনদের কেউ কেউ। তানভীর জানালেন, এই অবস্থার মধ্যেও এক দিন কাজ করে ৫০০ টাকা রোজগার করে পরে হাসপাতালে এসে ওষুধ কিনেছেন। এর আগে পদ্মা জেনারেলের টাকাও ধারদেনা এবং স্বজনদের কাছ থেকে জোগাড় করেছিলেন।
পাশে বসা নূরজাহান বেগমের এক স্বজন বললেন, তিনিও সেদিন ওই ক্লিনিকে উপস্থিত ছিলেন। ক্লিনিকে কে নার্স, কে আয়া, কিছুই চেনার উপায় নেই। ক্লিনিকে কর্মরতরা পালিয়ে যাওয়ার পরের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘চিকড়াপাকড়া (চিৎকার) করছি। মনে হইছে আমার বইনের কিডনি রাইখ্যা দিল কি না, কোন জায়গায় আইলাম। আমার নিজের একটা বাচ্চা হইছে, এই জীবনেও এমুন ঘটনার কথা শুনি নাই।’
নূরজাহান বেগমের স্বামী সিদ্দিকুর রহমান জানালেন, তিনিও জানেন না তাঁর স্ত্রীর অস্ত্রোপচার কে করেছেন। শুধু শুনেছেন তাঁর নাম ‘বেলা ম্যাডাম’। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঘটনার দিন স্ত্রী-সন্তানদের রেখে বাসায় গিয়েছিলেন টুকটাক জিনিস আনার জন্য। ফিরে দেখেন, ক্লিনিকের সামনে লেখা, সংস্কারকাজের জন্য এটি বন্ধ আছে। অথচ ভেতরে তাঁর স্ত্রী ভর্তি। তারপর তো সাংবাদিক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হুলুস্থুল লেগে যায়।
নূরজাহান বেগম এবং তাঁর নবজাতককে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগেই কথা হয় এই দম্পতির সঙ্গে। বাড়ি ফিরে কোন কোন নিয়ম মানতে হবে, বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন চিকিৎসক শামিনা সুলতানা (সিএ)। আগের ক্লিনিকে কে অস্ত্রোপচার করেছেন বা অস্ত্রোপচারের সময় আসলেই কী ঘটেছিল, তা জানেন না উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বললেন, চিকিৎসক না হয়ে দীর্ঘদিন দেখে দেখেও অনেকে অস্ত্রোপচার করা শিখে যান। আর সাত দিন না গেলে সংক্রমণ বা অন্য বিষয়ে সেভাবে বলাও যাচ্ছে না। সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং মা কোন কোন নিয়ম মানবেন, তা বলে দেওয়া হয়।
ঘটনা যেদিন ঘটে, ওই রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের ওই ক্লিনিকে প্রসূতিদের চিকিৎসায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক ছিলেন না।
আজ সকালে শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা মানুষকে পণ্য হিসেবে দেখেন। ঘটনার দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাঁকে খবর দেওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে চিকিৎসক-নার্সসহ অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। তখন শুধু মাথায় ছিল সেখানে আটকা পড়া মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে।
অস্ত্রোপচারের টেবিলে প্রসূতি মাকে ফেলে বাইরে তালা দিয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম এ মান্নান বললেন, ‘জঘন্যতম ও ন্যক্কারজনক কাজ হয়েছে। মানুষ এবং নিজে চিকিৎসক হয়ে ওই ঘটনার জন্য লজ্জা পাচ্ছি। ভুঁইফোড় অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতাল বন্ধ করতে না পারলে দরিদ্র মানুষ সেবা পাবে না।’