গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী হল–মার্কের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমদ বিধি লঙ্ঘন করে এক নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কারাগারের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করেছে। এঁদের মধ্যে আছেন কাশিমপুর-১ কারাগারের তখনকার জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায়, জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধা ও ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন।
গত ২১ জানুয়ারি তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে কারা কর্তৃপক্ষ। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনে ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা, চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া, কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিবর্তে জেলা কারাগারে পদায়ন করা ও কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করাসহ ২৫টি সুপারিশ করেছে।
কমিটির প্রধান অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক আবরার হোসেন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনটি সচিব খুলে দেখেছেন। পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে কাশিমপুর-১ কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায়, জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধা, ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন কারা অধিদপ্তরে সংযুক্ত আছেন। তদন্ত শুরুর পর তাঁদের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রত্যাহার করে কারা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিবেদনটি বাস্তবসম্মত হলে সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
প্রসঙ্গত, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী হল–মার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমদ বিধি লঙ্ঘন করে এক নারীর সঙ্গে সময় কাটান। এতে কারাগারের দুই কর্মকর্তা সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ৬ জানুয়ারি কারাগারের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ক্যামেরায় এ চিত্র ধরা পড়ে। ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন ১২ জানুয়ারি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটি।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটি ছাড়াও আরও অনেক অনিয়ম পেয়েছে কমিটি। এ ধরনের ঘটনা বন্ধে কারাগারে স্বজন বা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ করা যায় কি না, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশের কারাগারগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো এবং সেই সিসি ক্যামেরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
৬ জানুয়ারির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কারাগারের ভেতরে কর্মকর্তাদের অফিস এলাকায় কালো রঙের জামা পরে ঘোরাফেরা করছেন তুষার আহমদ। কিছু সময় পর বাইরে থেকে বেগুনি রঙের জামা পরা এক নারী সেখানে আসেন। এ সময় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায় ও ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন সেখানে ছিলেন।
দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে দুই যুবকের সঙ্গে ওই নারী কারাগারের কর্মকর্তাদের কক্ষের দিকে যান। সেখানে ওই নারীকে ডেপুটি জেলার সাকলায়েন স্বাগত জানান। ওই নারী কক্ষে ঢোকার পর সাকলায়েন বেরিয়ে যান। আনুমানিক ১০ মিনিট পর তুষারকে সেখানে নিয়ে যান সাকলায়েন। এর প্রায় ১০ মিনিট পর রত্না তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। দুই মিনিট পর রত্নার কক্ষের দিকে যান তুষার। আরও দুই মিনিট পর সেখান থেকে বেরিয়ে ওই নারীকে নিয়ে আবার রত্নার কক্ষে যান তুষার। যাওয়ার সময় তাঁদের হাসি-তামাশা করতে দেখা যায়। এর দুই মিনিট পর তুষার ও ওই নারী সাকলায়েনের কক্ষে ফেরেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তাঁরা বের হন।
ঘটনার পর ১৪ জানুয়ারি কারা মহাপরিদর্শকের কাছে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায় একটি প্রতিবেদন পাঠান। ভিডিও ফুটেজে রত্না রায়ের সম্পৃক্ততা দেখা গেলেও প্রতিবেদনে এই কর্মকর্তা নিজের কোনো দায় বা অবহেলার কথা উল্লেখ করেননি। তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, এক নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেতে হল-মার্কের জিএম তুষার আহমদ কাশিমপুর-১ কারাগারের দুজন কর্মকর্তা ও কয়েকজন কর্মচারীকে ঘুষ দিয়েছিলেন। তুষার জেলারকে ১ লাখ, ডেপুটি জেলারকে ২৫ হাজার এবং সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর, গেট সহকারী প্রধান কারারক্ষীকে ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছিলেন।
নিজের পাঠানো প্রতিবেদনে রত্না রায় ঘটনার জন্য জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধাকে প্রধানত দায়ী করেন। তিনি বলেন, নূর মোহাম্মদ মৃধার অনুমতি নিয়ে পুরো ঘটনার সঙ্গে ডেপুটি জেলার মো. সাকলায়েন ছিলেন। তিনি বলেন, ওই দিন দায়িত্ব পালনরত ডেপুটি জেলার ও কারারক্ষীদের জবানবন্দি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। রত্না রায় বলেন, যেহেতু পুরো ঘটনা জেলারের তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়েছে, তাই জেলারকে না জানিয়ে ওই দিন যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য জেলার নূর মোহাম্মদ মৃধা প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি মাত্র চার মাস আগে এ কারাগারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, জেল সুপার রত্না রায়ের নির্দেশেই তিনি তাঁদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁদের কারাগারে ঢোকার সময় জেল সুপার কারাগারের অফিসেই ছিলেন। তিনি ২০ মিনিট পর বের হয়ে যান। হল-মার্ক গ্রুপের পরিবারের সবার সঙ্গেই জেল সুপারের সখ্য রয়েছে বলে জানান জেলার নূর মোহাম্মদ।