জীবনের জয়গান ও জহির রায়হান

জহির রায়হানের কলম ও সমুদয় সৃজনকাজ বাংলার মানুষের বোবা কান্নাকে বিশ্বস্ত ভাষা দিয়েছে। অপমৃত্যু উজিয়ে জহির রায়হানের কাছ থেকেই তো আমরা পেয়েছি একুশের সূত্রে চিরকালীন সেই বিজয়ী প্রত্যয়—‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’

কলকাতায় ১৯৭১ সালে এক প্রতিবাদ সমাবেশে (বাঁ থেকে) পটুয়া কামরুল হাসান, জহির রায়হান ও অজয় রায়।
ছবি: সংগৃহীত

এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর আর ২০২২-এ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে আজ জহির রায়হানের জন্মের ৮৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, যাঁর জীবন ও সৃষ্টির সঙ্গে অচ্ছেদ্যসূত্রে গাঁথা ছিল অমর একুশে ও একাত্তর। মাত্র ৩৭ বছরে অসামান্য কথাশিল্পী, অনন্য চলচ্চিত্রকার, বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পী, নিবিষ্ট সম্পাদক, তুখোড় বামপন্থী কর্মী, বীর ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধার অনায়াস-অভিধায় ভূষিত তিনি।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীর মজুপুরের মৃত্তিকায় পৃথিবীর আলো দেখা মানুষটি বাংলার পথে–প্রান্তরে তাঁর স্বল্পকালের সক্রিয় জীবনে যে অমোচ্য পদচ্ছাপ রেখে গেছেন, তাকে তাঁরই উপন্যাসের শিরোনাম ধার করে চিহ্নিত করা যায় ‘হাজার বছর ধরে’-এর সমান তৃষ্ণাশীল এক মহৎ পরিক্রমা বলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও’ কবিতায় জহির রায়হানের দৃপ্ত উচ্চারণ:

‘মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে।’

মানুষের জন্য সুন্দর ও স্বপ্নিল জীবনের গানই গেয়েছেন জহির রায়হান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক বুক আশা নিয়ে দেশে ফেরেন জহির রায়হান। খবর পেয়েছিলেন, ঢাকার মিরপুরে অগ্রজ, কথাশিল্পী শহীদুল্লা কায়সারকে আটকে রেখেছে পাকিস্তানি সমর্থকেরা। তখনো মিরপুর মুক্ত হয়নি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর মুক্ত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অভিযান চালায়। তাদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সমর্থকেরা গুলি করে হত্যা করে জহির রায়হানকে। নিহত হন অনেক সেনা ও পুলিশ সদস্যও। পরদিন ৩১ জানুয়ারি আবার অভিযান চালিয়ে মিরপুর দখলমুক্ত হলেও লাশ পাওয়া যায়নি জহির রায়হানের।

মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ এবং দুই দশকের সাহিত্যচর্চায় ৭টি উপন্যাস, ২টি গল্পগ্রন্থ; ২৬ বছর বয়সে প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা কখনো আসেনি, এক দশকের চলচ্চিত্রচর্চায় বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষার ১০টি চলচ্চিত্র পরিচালনা (এর মধ্যে পুরো পাকিস্তানের প্রথম টেকনিকালার ছবি সংগম, প্রথম সিনেমাস্কোপ বাহানা), কিছু প্রযোজনা; প্রবাহএক্সপ্রেস–এর মতো আলোড়ক সাময়িকপত্র সম্পাদনা তাঁর জীবনের স্মরণীয় কীর্তি। পাকিস্তান আমলে পেয়েছে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা বইয়ের পুরস্কার।

অবিস্মরণীয় এই জহির রায়হানকে নিবিড় আবিষ্কার করা যায় স্মৃতি ও মূল্যায়নের আলোছায়ায়।

৬ জুলাই ২০২০ কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাইয়ের ফেসবুক নোটে জানা যায় গল্পের সংলাপ-সন্ধানী জীবনঘনিষ্ঠ জহির রায়হানকে:

‘জহির রায়হান, আমাদের সবার জহির ভাইকে নিয়ে পঞ্চাশের দশকে একটি গল্প চালু ছিল; তিনি নাকি তাঁর গল্পের সাধারণ মানুষের মুখের কথা শোনার জন্য পাশের চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। উপযুক্ত সংলাপ শুনলেই সামনে রাখা নোটবইতে টুকে নিতেন।’

সদ্যই প্রয়াত হলেন জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠজন মুর্তজা বশীর। তাঁর আত্মকথার পাতায় পাতায় ভাস্বর বিরল বন্ধু জহির; যিনি বশীরের বই, প্রামাণ্যচিত্র এবং চিত্রকলারও অন্যতম প্রেরণা ছিলেন।

চলচিত্র পুরস্কার হাতে জহির রায়হান।

মুর্তজা বশীরের ভাষ্যে:

‘আমার প্রথম ছোটগল্পের বই কাচের পাখীর গান সন্ধানী প্রকাশনী থেকে ১৯৬৯ সালে বের হয়। বইটির প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দীন, তাঁকে বন্ধু জহির রায়হান অনুরোধ করেছিল। গ্রন্থটিতে জহির রায়হান ভূমিকাও লিখেছিল।

...

‘জহির আমাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি বিষয়ে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানোর কাজ দিলো।

...

‘“দেয়াল” সিরিজ করার প্রেরণা পেয়েছিলাম জহিরের দুটি প্রণয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কোথায় যেন দেয়াল উঠছে। সমাজেও দেখছি নানারূপী দেয়াল। মানবিক সম্পর্কগুলোর ভেতর মাথা তুলছে দেয়াল।’

জহির রায়হানও তো তাঁর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েও ভাঙতে চেয়েছেন মানবিক সম্পর্কের মধ্যে গজিয়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতার অতিসূক্ষ্ম ‘কাচের দেয়াল’।

জহির রায়হান, একুশ, একাত্তর—এই শব্দবন্ধগুলোকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই কোনো। ভাষা আন্দোলনের সামনের সারির লড়াকু ও কারাবরণকারী জহির তাঁর উপন্যাস একুশে ফেব্রুয়ারী, গল্প ‘মহামৃত্যু’, ‘সংলাপ’, ‘একুশের গল্প’ আর কালজয়ী চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়ার মধ্য দিয়ে একুশের অমর আবহকে দিয়েছেন শৈল্পিক মহিমা।

একুশের মতোই বুকে ধারণ করেছেন একাত্তরের আগুন। স্বাধিকারের দাবিতে একাত্তরের মার্চে ঢাকায় গঠিত ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’–এর অন্যতম সদস্য জহির রায়হান একাত্তরের কলকাতা-জীবনে ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পসংস্থা’র সাধারণ সম্পাদক হন। স্টেনগানের বদলে ক্যামেরা আর ফিল্মের রিল নিয়ে মুক্তির ময়দানে জারি থাকে তাঁর চলচ্চিত্রযুদ্ধ; স্টপ জেনোসাইড, বার্থ অব নেশন পরিচালনা কিংবা লিবারেশন ফাইটারস, ইনোসেন্ট মিলিয়নস প্রযোজনার মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেন বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রামাণ্যভাষ্য।

একুশ ও একাত্তরের জহির রায়হান যেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেও একাকার। ‘একুশের গল্প’-এর নায়ক তপুকে তো আমরা সবাই চিনি ভাষা আন্দোলনের শহীদরূপে, যার মাথার খুলি তারই বন্ধুরা আবিষ্কার করে মেডিকেল কলেজে রাখা কঙ্কাল হিসেবে। সে-ই তপুর আরও একবার জহির রায়হানের সৃষ্টিতে আসার বিষয়টি নিয়ে ‘জহির রায়হান: জীবনের একটু আগুন চাই’ লেখায় মতিউর রহমান বলেন:

‘“আর কতদিন”-এর নায়ক তপুকে আমরা দেখতে পাই জহির রায়হানের “একুশের গল্প”তেও। সেই তপু আবার ফিরে আসে “আর কতদিন”–এর নায়ক হয়ে। অথচ স্বাধীনতার পর অগ্রজকে খুঁজতে গিয়ে জহির রায়হানই তো আরেক তপু হয়ে যান।’

এভাবে জহির রায়হান তপুর রূপকে মিশে থাকেন একুশ ও একাত্তরময় সারা বাংলাদেশে।

‘জহিরকে যেমন জানতাম’ শীর্ষক লেখার রেখায় তাঁর সমসাময়িক কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন এঁকেছেন দায়বদ্ধ লেখক জহির রায়হানের অমলিন মুখচ্ছবি—

‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ওর প্রিয় পাঠ্য। তাঁর প্রতি নিদারুণ সম্মোহন। বলত, এমন দেখার চোখ আমি কবে পাব! মনের মধ্যে কথা টগবগ করছে, কলমের মুখ বোবা। অসহ্য।’

আমরা তো জানি, জহির রায়হানের কলম ও সমুদয় সৃজনকাজ বাংলার মানুষের বোবা কান্নাকে বিশ্বস্ত ভাষা দিয়েছে। অপমৃত্যু উজিয়ে জহির রায়হানের কাছ থেকেই তো আমরা পেয়েছি একুশের সূত্রে চিরকালীন সেই বিজয়ী প্রত্যয়—

‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’