১৯৮১ সাল, বাকেরগঞ্জের চরাদি গ্রামের আলম শিকদার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কৃষক বাবা ইসমাইল হোসেনের আয়ে পরিবার চলে না। আলম শিকদারকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। বরিশালে লঞ্চের খালাসির কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও এ কাজ বেশি দিন করতে পারেননি। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে পাগল আর কুকুরের পাশে ঘুমিয়েছেন, নাখেয়ে থেকেছেন।আবার ফেরেন বরিশালে। আইসক্রিম বিক্রিও করেন। পরে বরিশালের সংবাদপত্র এজেন্ট এম রহমান নিউজ এজেন্সির মালিক মকলেছুর রহমান আলম তাঁকে কাজ দেন পত্রিকা বিক্রির। শুরু হয় হকারজীবন।প্রতিদিন আয় হতো ১০ থেকে ১২ টাকা। দুপুরে খেতেন একটি পাউরুটি ও একটি কলা। এ টাকা থেকেই কিছু সঞ্চয় করেন। ১৯৮৪ সালে হকারি ছেড়ে শুরু করেন পুরোনো ম্যাগাজিন বিক্রি। ১৯৮৫ সালে দুটি সাপ্তাহিক কাগজের এজেন্সি নিলেন আলম শিকদার। একে একে সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকার এজেন্সি নিয়ে নেন, নিয়ে নেনআলম বুক স্টল নামে বর্তমানে লঞ্চঘাটের দোকানটি। হয়ে যান সংবাদপত্রের এজেন্সির মালিক। যেখানে বসে তিনি প্রতিদিন নিজ হাতে এখনো বিতরণ করছেন পত্রিকা।
আলম শিকদারের বাবা মারা গেছেন। আলম দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন। বরিশালে দুটি বাড়ি করেছেন। ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট। গাড়িও কিনেছেন। স্ত্রী,সন্তান ও মাকেনিয়ে ভালোই আছেন আলম। তবে আলম শিকদার ভুলে যাননি তাঁর অতীতকে। তাঁর মতে, জীবনে সৎ থাকলে, মন স্থির করে ব্যবসা করলে সবাই সফল হবেন।
১৯৪৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে মা–বাবা পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। বরিশালের বাড়ি থেকে বের হয়ে কলকাতায় চলে যান মো. আনোয়ার হোসেন। কলকাতার ধর্মতলা স্টেটের স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় পত্রিকার ব্যবসায় যুক্ত হন। প্রথম দিকে আনন্দ বাজার, যুগান্তর ও আজাদ পত্রিকা বিক্রি করতেন। কাজ ভালো না লাগায় চলে আসেন দেশে। নারায়ণগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ডে কাজ নেন। কিছুদিন কাজ করার পর ১৯৪৫ সালে ঢাকার আজিমপুরে গ্রামের এক মামার দোকান থেকে আবার পত্রিকার ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে হেঁটে ঢাকার অলিতে–গলিতে পত্রিকা বিক্রি করতেন। তারপর একদিন পত্রিকা নিয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে পত্রিকা বিক্রি করতে করতে চলে যান ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। এভাবেই প্রতিদিন পত্রিকা অফিস থেকে পত্রিকা নিয়ে ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি করতেন। ১৯৫০ সালে চলে আসেন টঙ্গীতে। পত্রিকার ব্যবসার পাশাপাশি ১৯৫১ সালে কাওরাইদ উচ্চবিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হলে আর পড়াশোনা করেননি। ১৯৫৩ সালে যখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা বের হয়, তখন আনোয়ার হোসেন ট্রেনে ট্রেনে শুধু ইত্তেফাক পত্রিকাই বিক্রি করতেন। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় পয়েন্ট তৈরি করেন। পয়েন্টের হকাররা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতেন। ট্রেন এলে আনোয়ার জানালা দিয়ে পত্রিকা ফেলে দিতেন, তখন হকাররা তা নিয়ে এলাকায় বিক্রি করতেন। ইত্তেফাক বের হওয়ার পর আনোয়ার আজাদ পত্রিকা বিক্রি করা বন্ধ করে দিলেন। কারণ, আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের কথা বেশি লেখা হতো। এটি বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান মুসলিম লীগের সমর্থকেরা তাঁকে শারীরিকভাবে অনেক নির্যাতন করেন। ১৯৭১ সালে কর্মচারীর কাছে পত্রিকার দায়িত্ব দিয়ে আনোয়ার চলে যান সুন্দরবনে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হলে আবার পত্রিকার ব্যবসায় মনোযোগ দেন। ৯৩ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন এখনো নিয়মিত পত্রিকার খোঁজখবর রাখেন।
মো. রেদোয়ান যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাঁর বাবা মানসিক ভারসাম্য হারান। মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্তু আট সদস্যের বড় পরিবারটিকে চালানো কঠিন হয়ে যায়। রেদোয়ানপড়া বাদ দিয়ে কাজ খুঁজতে লাগলেন। এলাকার এক মুরব্বির মাধ্যমে পরিচয় হয় মো. ফকরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকার এজেন্ট। তবে তিনি জানান, তাঁর সঙ্গে কাজ করতে হলে রেদোয়ানপড়া বাদ দিতে পারবেন না।রেদোয়ান আবার গকুলনগর উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করলেন। শুধু রেদোয়ানই নন, ফকরুলের সঙ্গে কাজ করা ১২ জন হকারই শিক্ষিত।
ফকরুল ইসলাম নিজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্বে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরি না করে বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন।তাঁর বাবা মো. নুরুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের টেকনিক্যাল অফিসার ছিলেন। ১৯৭২ সালে ড.আফমকামালউদ্দিনের সহায়তায় পত্রিকা ব্যবসায় যুক্ত হন।
ফকরুলের ভাষায়, এই দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে শিক্ষিত হতেই হবে। ছেলেগুলো যদি কাজের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যায়, সবারই উপকার হবে। ফকরুল শুধু যে পড়ালেখার ব্যাপারে উৎসাহ দেন, তা–ই নয়, বিভিন্ন সময় হকারদের বই, খাতা, জামাকাপড় কিনে দেন।