বিকেলবেলা চায়ের কাপ হাতে করে ইদানীং প্রায়ই মায়ের সঙ্গে বসে যাই জি বাংলার ভারতীয় ধারাবাহিক দেখতে। মা অবশ্য খুব কমই দেখে, এক-দুটি বড় জোর। তার মধ্যে একটি হল ‘রানী রাসমণি’ আর অন্যটি হলো ‘কাদম্বিনী’।
এমনিতে বাসার বাইরেই থাকা হয়, খুব একটা টিভি দেখা হয় না। গত কয়েক মাস মহামারির কারণে বাসায় থাকা আর টিভি দেখা হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে সমান্তরালে অপর চিন্তাগুলো মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে। এই যে বাংলা ভাষায়ই পার্শ্ববর্তী দেশে এত জীবনীভিত্তিক কাজ হচ্ছে, চমৎকার অভিনয়ের মাধ্যমে লাখো দর্শককে টিভির সামনে আটকে রাখছে, একই সঙ্গে পৌঁছে দিচ্ছে ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় বার্তা—আমরা কেন পারি না এমন?
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এক সম্মেলনে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ওখানে পশ্চিমবঙ্গের একজন বললেন, তিনি অবসর সময়ে ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখেন। এরপরে গত বছর আবারও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। এখন আর তেমন একটা বাংলাদেশি নাটক তিনি দেখেন না। আমাদের নাটকের মান বেশ লক্ষণীয়ভাবে নিচে পড়ে গেছে—সেটা বুঝতে বিরাট নাটকবোদ্ধা হতে হয় না। অধিকাংশ মানুষ আলোচনার সময় কূট কাহিনিবিশিষ্ট ভারতীয় ধারাবাহিকগুলোর কথাই বলেন, ভালোটা কেন খেয়াল করেন না, সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। কিছু চ্যানেলে ডেইলি সোপ ধাঁচের এসব ধারাবাহিক প্রচার করা শুরু করেছে, যার পরতে পরতে সেই কূটনামি, অযথা পারিবারিক কলুষতাই দেখা যায়। চোখ বুজে খারাপের অনুসরণ করলেই কি হয়? ভালো কাহিনিগুলো থেকে কেন শিখতে পারি না? উন্মুক্ত বিশ্বে সব দেশের সংস্কৃতির প্রবেশ টিকিট রয়েছে সর্বত্র। টিকে থাকতে হলে দরকার মানসম্মত ধারাবাহিক, অথচ আমাদের একগাদা চ্যানেলে হাজারো বিষয়ের নাটক থাকলেও নেই সেসবের কোনো প্রতিচ্ছবি!
সমগ্র নাটকের মান নিয়ে আলোচনা আমি করতে চাই না। আমি বলছি কেবল ব্যক্তিগত চিন্তার কথা। আমার দুঃখ হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে হাজারো কিংবদন্তি রয়েছেন, অথচ আমরা তাঁদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারছি না। ভারতীয়রা পারছে, ওখানে জীবনীভিত্তিক ধারাবাহিক প্রচুর চলে। আমি ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখলাম বাংলা ভাষার চ্যানেলগুলো যেমন জি বাংলা, স্টার জলসা, কালারস বাংলা ইত্যাদিতে বেশ কিছু জীবনীভিত্তিক ধারাবাহিক চলছে। অথচ আমাদের টিভিগুলোর দিকে তাকাই, এ রকম মানসম্মত ধারাবাহিক আদৌ আছে কি? যে দুটি ধারাবাহিকের কথা বললাম, তার একটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রানী রাসমণি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার, আর অপর একটির চরিত্র কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক। অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা এই ধারাবাহিকগুলো অভিনীত হচ্ছে। টিআরপিতেও এরা শীর্ষে। চমকপ্রদ কাহিনি, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, মানুষ দেখবে না-ই বা কেন? আর এভাবে তাদের মধ্যে পরোক্ষভাবে হলেও প্রবেশ করছে শিক্ষণীয় বার্তা, যা উঠে এসেছে সত্যিকারের ইতিহাসের পাতা থেকে।
জাতিগতভাবে আমরা ভাগ্যবান, অসংখ্য কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে এই ভূমিতে। অথচ আমাদের টেলিভিশনে নেই কোনো রকম জীবনীভিত্তিক ধারাবাহিকের নাম-নিশানা। শুধু মুখে আর পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস পড়িয়েই কি সব হয়? নিছক মুখস্থ করে এই ইতিহাস তারা কি অনুভব করে? যদি সত্যি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন আমরা নিশ্চিত করতে চাই, সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সমাজে পৌঁছে দিতে হবে সেই নির্যাস, না হলে কোনো দিনই তা মনের ভেতর গিয়ে পৌঁছাবে না। কিন্তু হায়, কোথায় সেই দক্ষ চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, যাঁরা ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে কিঞ্চিৎ কল্পনামিশ্রিতভাবে অসাধারণ আকর্ষণীয় কাহিনি পৌঁছে দেবে দর্শকের কাছে?
নাম বলতে গেলে তো শেষ হবে না। জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী একজনের জীবনী নিয়ে কি কোনো কাজ হতে পারে না? যিনি তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেলেন দেশের জন্য, মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করলেন নিজের পুত্রকে, এরপর থেকে তাঁর বাকিটা জীবন ছিল সংগ্রামের জীবন। আমরা কি পারি না বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসতে তাঁর কাহিনি?
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণামূলক কোনো ধারাবাহিক কি আমরা করতে পারি না? বর্তমান প্রজন্মের কজন জানেন বেগম রোকেয়ার প্রকৃত জীবনী, কজন আত্মস্থ করতে পেরেছেন তাঁর অবদান? শুধু ইতিহাসে আর সৃজনশীল প্রশ্নে তাঁর নাম আটকে রেখে প্রকৃত শিক্ষা অন্তরে স্থান লাভ করতে পারে কি?
কয়জনের নাম আলাদাভাবে বলব? আছেন সুফিয়া কামাল, আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা রায়। তাঁদের জীবন কতটা কঠিন ছিল, আজ কালের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা অবাক হয়ে ভাবি। আজ একবিংশ শতকে এসেও নারীশিক্ষার পথে বাধার অন্ত নেই, তবুও আগের তুলনায় উন্নতির কথা বলাই বাহুল্য। এই মহীয়সী নারীরা কত বছর আগে সংগ্রাম করে গেছেন বলেই তো আমরা আজ এই আলো দেখতে পাই। তাঁদের কথা জীবন্ত ফুটিয়ে তোলাটা কি আমাদের দায়িত্ব নয়? ধারাবাহিক যাঁরা নির্মাণ করেন, তাঁরা কেন সমাজের সর্বস্তরে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার এই ভারটুকু গ্রহণ করেন না?
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান নিয়ে কোনো ধারাবাহিক নির্মিত হয়েছে কি? তারামন বিবি, সিতারা বেগম আমাদের দুই নারী বীরপ্রতীক। অথচ কয়জন তাঁদের নাম জানেন? কেন টিভির পর্দায় জীবন্ত ফুটিয়ে তুলি না আমরা তাদের কথা? টিআরপি নিয়েও ভাবতে হবে না যদি নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় থাকে, এসব মহীয়সী নারীদের জীবনী গল্প-উপন্যাসকে যে হার মানায় অনায়াসে। মেধাসম্পন্ন নির্মাণ দল থাকলে প্রযোজকেরাও কি এগিয়ে আসবেন না? এটা যে গোটা দলের জীবনেরই শ্রেষ্ঠ একটি কাজ হবে।
আমার লেখায় হয়তো জ্ঞানের বা লেখার সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে অনেকের নামই নিতে পারিনি, এ জন্য পাঠকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। মহীয়সী বিদুষীদের সংখ্যা যে দেশে কোনো দিক থেকেই কম নয়, কেবল প্রয়োজন নজর দেওয়া, সেটা বলাটাই আমার অভিপ্রায় ছিল।
আমাদের গৌরবের ইতিহাস ছিল, ইউটিউবে ‘আজ রোববার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ থেকে শুরু হয়ে হালের অনেক নাটকও এর জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা এখনো পারি, তবে অতিরিক্ত করপোরেট এ দুনিয়ায় দ্রুত অধিক সংখ্যায় মানহীন ধারাবাহিক বানানোর প্রতিযোগিতায় তা হারিয়ে গেছে। দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, গল্পকার, গবেষক—কীসের অভাব আমাদের? অভাব কেবল সমন্বয় আর আগ্রহের।
জাগো বাহে, কোনঠে সবায়?
*লেখক: শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বুয়েট। ankanghoshdastider@gmail.com