প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি তাঁর জীবনকে দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য, তাঁর আর কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি তাদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী শনিবার বিকেলে গণভবনে লায়ন এবং লিও ক্লাব আয়োজিত সমাবেশে এ কথা বলেন। তিনি দেশে লায়ন্সের সেবামূলক কর্মসূচির প্রশংসা করে ভবিষ্যতেও দেশ ও মানবতার কল্যাণে তাঁদের এসব সেবামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা লায়ন এবং লিওরা যেভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন, আপনাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। মানুষের জন্য সেবা করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, এর থেকে বড় কাজ আর কী হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা যে সেবা দিচ্ছেন, সে সেবা আপনারা অব্যাহত রাখবেন। দেশকে আসুন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলি।’ তিনি বলেন, দেশের এই উন্নয়ন অভিযাত্রায় লায়ন ও লিও সদস্যদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা তাঁদের মানবসেবামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডে সব রকমের সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে।
‘মাত্র কয়েক বছর আগেও বিশ্বে বাংলাদেশ একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপীড়িত দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও আজ তা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে আমরা বিশ্বে বাংলাদেশের হৃত মর্যাদাটা অন্তত ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, যেটা ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাঙালি জাতি হারিয়ে ফেলেছিল।’
অনুষ্ঠানে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের নবনির্বাচিত পরিচালক কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাবেক আন্তর্জাতিক পরিচালক শেখ কবির হোসেন, এরিয়া লিডার স্বদেশ রঞ্জন সাহা, চেয়ারম্যান অব মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ বি মমিনুল ইসলাম লিটন বক্তব্য দেন। লিটন এরশাদ হোসেন রানা অনুষ্ঠানে শপথবাক্য পাঠ করান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করব। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।’ তাঁর সরকার শত বছরের ডেল্টা প্ল্যান বা বদ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক টেকসই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আর্থসামাজিক সূচকে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত। প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে।’
‘আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেট্রোরেল স্থাপন, এলএনজি টার্মিনাল এবং গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, তাঁর সরকার সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৩ হাজার ৮৪২ জন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী নিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছে। রোগীদের বিনা মূল্যে ৩০ প্রকারের প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর হার ২৮ ও মাতৃমৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭৬-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছরের বেশি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের লিও আন্দোলন কর্মসূচি আপনাদের সকল কর্মকাণ্ডে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভবিষ্যতে একটি সুশৃঙ্খল যুবশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি পেশাগত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।’
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাজেট সাত গুণ বাড়িয়েছি। বাজেটের ৯০ ভাগ নিজস্ব অর্থায়নে আমরা করে থাকি। আগে আমাদের উন্নয়ন বাজেট যা হয়তো ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা ছিল, এখন সেখানে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।’
দেশের উন্নয়নে নেওয়া পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশকে আমরা সর্বক্ষেত্রে উন্নত করতে চাই, স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চাই। দেশের মানুষ যেন আরও উন্নত জীবন পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনালের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল জাতিসংঘের কনসালটেটিভ স্ট্যাটাস প্রাপ্ত, বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবসেবামূলক সংগঠন। সমাজের দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিবেদিত এই সংগঠন বিগত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ২০০ টিরও অধিক দেশে মানবসেবায় কাজ করে যাচ্ছে।’
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে আমাদের ওপর একটা বোঝা এসেছে, মিয়ানমারের শরণার্থীরা। প্রায় ১১ লাখ শরণার্থী আজকে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আমাদের শরণার্থীদের কথা যখন স্মরণ করেছি, তখন তাদের আশ্রয় না দিয়ে পারিনি।’
রোহিঙ্গা সংকটে কূটনৈতিক সফলতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ঝগড়া করিনি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সই করেছি। তারা রাজি হয়েছে নিয়ে যাবে, যদিও এখনো নিয়ে যাওয়া শুরু করেনি। তারপরও আমরা আলোচনা করে যাচ্ছি এদের ফিরিয়ে দিতে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘অরাজনৈতিকভাবে আজকে যে সমর্থন বাংলাদেশ পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের (মিয়ানমারকে) চাপ প্রয়োগ করছে। আমরা আশা করি তাদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন বলেই আমরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব যেমন করতে পারছি, তেমনি বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতেও অবতীর্ণ হতে পারছি এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর জাতির পিতা হাতে সময় পেয়েছিলেন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্রদেশকে রাষ্ট্রে পরিণত করার। তিনি মাত্র ৯ মাসে আমাদের একটি সংবিধান উপহার দিতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতিকে উন্নত সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার প্রতিটি কাজের তিনি সে সময়ই ভিত্তিমূল গড়ে দিয়ে যান।’