আমার সোনার বাংলা

জাতীয় সংগীতের স্টাফ নোটেশন

অনুমোদিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের টেপ যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানের (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) হাতে তুলে দেন বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান মার্ক ডড (বাঁয়ে)। উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে ডেভিড কক্স (সংগীত পরিচালক), জেফ্রি ব্র্যান্ড ও শিল্পী আবদুর রউফ l ছবি: সংগৃহীত
অনুমোদিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের টেপ যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানের (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) হাতে তুলে দেন বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান মার্ক ডড (বাঁয়ে)। উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে ডেভিড কক্স (সংগীত পরিচালক), জেফ্রি ব্র্যান্ড ও শিল্পী আবদুর রউফ l ছবি: সংগৃহীত

১৯৭২ সাল। বাংলাদেশ নামে নতুন দেশটির জন্য একটি উপহার পাঠাল বিবিসি। সেটি হচ্ছে দেশটির জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন। সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের আকারমাত্রিক স্বরলিপির ওপর ভিত্তি করে আগেই গানটির পাশ্চাত্য সুরলিপি বা স্টাফ নোটেশন লিখেছিলেন সংগীতজ্ঞ ভি. ভালসারা। অর্কেস্ট্রেশনের জন্য তাঁর কাছ থেকে ওই নোটেশনটি নিয়েছিলেন বিবিসি বাংলার কর্মী তৃপ্তি দাস। সেটি বাজিয়েই ধারণ করা হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের অর্কেস্ট্রেশন। পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
সে সময় জাতীয় সংগীত কমিটির প্রধান সংগীতজ্ঞ সমর দাস ওই অর্কেস্ট্রেশনের অনুমোদন দেননি। বরং বিবিসিকে তিনি জানিয়েছিলেন, এতে গন্ডগোল আছে। তাঁর উপস্থিতিতে নতুন করে অর্কেস্ট্রেশনটি করতে হবে। বিবিসি তখন সমর দাসকে নিয়ে যায় লন্ডনে। তাঁরই তত্ত্বাবধানে সে বছর ধারণ করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র অর্কেস্ট্রেশন। তাতে সামান্য পরিবর্তন করেন তিনি। মূল গানে যেখানে ‘চিরদিন তোমার আকাশ’ দুইবার গাওয়া হয়, তিনি সেটি একবার বাজানোর নির্দেশনা দেন। অনেক দিন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে সেভাবেই বাজানো হতো জাতীয় সংগীত।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে সেই সময়ের বিবিসির কর্মী সিরাজুর রহমান তাঁর এক জীবন এক ইতিহাস বইতে লিখেছেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় বিবিসিতে তিনি একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। লিখেছেন, ‘বিবিসি থেকে এ উপলক্ষে একটা বিশেষ জীবন্তিকা নিবেদন করি। আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। গ্রামোফোন রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে গানটি দিয়েই সেই ফিচারটি শুরু করেছিলাম।’ বিবিসির অভ্যন্তরীণ রেডিওর সংগীত প্রযোজক ডেভিড কক্স ভি. ভালসারার করা ‘আমার সোনার বাংলা’র স্টাফ নোটেশন থেকে বাজিয়ে ধারণ করেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। ১৯৭৩ সালের শুরুর দিকে এক অনুষ্ঠানে বিবিসি প্রাচ্য বিভাগের অধ্যক্ষ মার্ক ডড বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার সৈয়দ আব্দুস সুলতানের কাছে জাতীয় সংগীতের ওই রেকর্ড তুলে দিয়েছিলেন।
জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো দুইভাবে
এত দিন ধরে জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো দুইভাবে। একটিতে ‘চিরদিন তোমার আকাশ’ একবার, অন্যটিতে দুবার গাওয়া হতো। একপর্যায়ে এ নিয়ে আপত্তি তোলে ছায়ানট। তারা দাবি করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গানটি ঠিক রেখেই গানটি গাওয়া উচিত। শান্তিনিকেতনের প্রচলিত সুরে সুচিত্রা মিত্র ১৯৪৮ সালে প্রথমবারের মতো ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি এইচএমভিতে ধারণ করেন। সেটি অনুসরণ করে স্বরলিপি তৈরি করেন শান্তিদেব ঘোষ, যেটি পরে সংযোজিত হয়েছে স্বরবিতানে। সেখানে ‘চিরদিন তোমার আকাশ’-এর উল্লেখ আছে দুবার। ১৯০৬ সালে গানটির প্রথম আকারমাত্রিক স্বরলিপি তৈরি করেন উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। সেখানেও ‘চিরদিন তোমার আকাশ’ দুইবার। তারেক মাসুদ পরিচালিত মুক্তির গান চলচ্চিত্রেও বাংলাদেশের শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে ওই অংশটুকু দুইবার গাওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুনকে প্রধান করে একটি জাতীয় কমিটি করা হয়। কমিটি জাতীয় সংগীতের সঠিক গীতরূপ ও যন্ত্রভাষ্যকে একটি ধরনে নিয়ে আসেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গান অনুসরণে ‘চিরদিন তোমার আকাশ’ দুইবার এবং ‘মা তোর মুখের বাণী’ গাওয়ার সময় আড়ি না ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গানটি গেয়ে শোনান এবং তাঁর কাছ থেকে সংশোধিত গীতিরূপটির মৌখিক অনুমোদন নেন। ওই সুরেই ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ লাখো কণ্ঠে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা’। এরপর ছায়ানটের নির্বাহী কর্মকর্তা অনিন্দ্য রহমান সেটির একটি স্বরলিপি তৈরি করেন, স্টাফ নোটেশন তৈরি করেন ফিলিপ হাজরা। এমনকি ২৯টি যন্ত্রে এর একটি অর্কেস্ট্রেশনও করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এখনো অনুমোদিত নয়। রেডিও-টেলিভিশনসহ যে মাধ্যমগুলোতে যন্ত্রসংগীতে গানটি বাজানো হয়, সে জায়গাগুলোতে এখনো পরিবর্তিত ধরনে বাজানো শুরু করা যায়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা, যেটি থেকে স্টাফ নোটেশন সংগ্রহ করে বিশ্বব্যাপী ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজানো হয়, সেখানেও পাঠানো হয়নি নতুন নোটেশন। ‘ন্যাশনাল এন্থেম অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের ওই সংগ্রহশালাটিকে ২০১০ সালে কিনে নেয় নেক্সাস গ্রুপ। নেক্সাসের প্রধান সংগীত পরিচালক পিটার ব্রেইনর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন পুনরায় করেছেন।
স্টাফ নোটেশন সংশোধনের জন্য অনেক দিন ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশের সংগীত অনুরাগী ও নকশাকার টুটু সাদউল্লাহ। তিনি নেক্সাস গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের আর্কাইভে রক্ষিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের নোটেশনের ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তারাও সেটি সংশোধনে আগ্রহী। বর্তমান জাতীয় সংগীত কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে শিল্পী ফিলিপ হাজরার মাধ্যমে একটি স্টাফ নোটেশন তৈরি করিয়ে নেন টুটু সাদউল্লাহ। ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন সেটি সমর্থন করেছেন। এরই মধ্যে গত বছর জাতীয় সংগীতের আরেকটি স্টাফ নোটেশন ও অর্কেস্ট্রাল কনডাক্ট করেন বাংলাদেশের আরেক তরুণ সংগীতজ্ঞ সানি জুবায়ের।
এখন ‘আমার সোনার বাংলা’র সংশোধিত ধরনটি লিখিত অনুমোদনের অপেক্ষায়। তারপরই পাশ্চাত্য সুরলিপি বা স্টাফ নোটেশনটি পাঠানো যাবে আন্তর্জাতিক আর্কাইভে। তাতে দেশ-বিদেশের সব জায়গায় একই সুরে বাজবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।