জেনেভায় ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনায় দুই ঘটনা
পরিস্থিতি দেখতে ২০১৩ সাল থেকে সফরের অনুরোধ, সাড়া নেই সরকারের
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুমের যেসব অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অন্তত দুটি গুমের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। গত সোমবার থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত জেনেভায় এই বৈঠক হয়। গুমবিষয়ক বৈঠক নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের জুনের অধিবেশনে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে ওয়ার্কিং গ্রুপ, যা নিয়ে ওই অধিবেশনে আলোচনা হতে পারে।
অবশ্য জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের উল্টো। সরকারের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় জেনেভায় কমিটির বৈঠকগুলোতে বলে আসছে বাংলাদেশের আইনে ‘গুম’ বলে কিছু নেই। বিশেষ করে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিগুলোর বৈঠকে সরকারের এমন অবস্থান তুলে ধরছে। যদিও ২০১২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ইউপিআর পর্যালোচনায় ‘গুম’ আর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’কে দুঃখজনক অভিহিত করেছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওয়ার্কিং গ্রুপের ৫ দিনের এই বৈঠকে ৩৬টি দেশের ৬০০–এর বেশি গুমবিষয়ক অভিযোগ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশের দুটি ঘটনা। এর একটি হচ্ছে আনসার আলী নামের এক ব্যক্তি ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকায় ‘অস্ত্রধারী সরকারি বাহিনী’ অপহরণ করে নিয়ে গেছে। আর ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোর মিউনিসিপ্যালটি পার্ক থেকে সাইদুর রহমান কাজী নামের এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। কমিটি এই দুই গুমের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ১২২তম অধিবেশন শেষে ডিসেম্বরে গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের গুমবিষয়ক ২২৪টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ৫৬টি, চীনে ৫২টি, পাকিস্তানে ৩৭টি ও রাশিয়ায় ২৩টি গুমের প্রসঙ্গ এসেছে। ওসব অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওয়ার্কিং গ্রুপের ওই প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ব্লগার আসাদুজ্জামান নূরের (আসাদ নূর) আইনজীবীকে হুমকি, হয়রানি করা নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ সরকারকে চিঠি দিয়েছিল।
বাংলাদেশের গুম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ওয়ার্কিং গ্রুপ তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে গুমের অব্যাহত অভিযোগ নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বিগ্ন। ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়মিতভাবে গুমের অভিযোগ পাচ্ছে। আর এসব অভিযোগের অনেকগুলোই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। গুমের অভিযোগ নিয়ে দৃশ্যত দায়মুক্তির চর্চা নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বিগ্ন।
গুমের অভিযোগ নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা না থাকার ঘটনাকে পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। গত বছর ওয়ার্কিং গ্রুপ অভিযোগগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেও বাংলাদেশ সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। ১৯৯৬ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে প্রথমবারের মতো একটি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। তখন থেকে এত বছরে মাত্র একটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ।
২০১৩ সাল থেকে গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সফরের অনুমতি পেতে বেশ কয়েকবার অনুরোধ জানিয়েছে। সবশেষ গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশকে সফরের অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি ওয়ার্কিং গ্রুপ।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ার র্যাপোর্টিয়ার দক্ষিণ কোরিয়ার তায়-উং বাইক। ভাইস চেয়ার হেনরিকাস মিকেভিশাস (লিথুনিয়া) ছাড়াও সদস্য হিসেবে আওয়া বালদে (গিনি বিসাও), বের্নার্ড দুহাইম (কানাডা) ও লুসিয়ানো হাজান (আর্জেন্টিনা) ওই পর্যালোচনা বৈঠকে অংশ নেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কাজের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অতীতে ও বর্তমানে যুক্ত বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, সাধারণত গুমসহ স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের এ ধরনের সফরের অনুরোধ সদস্য দেশগুলো এড়িয়ে চলে। কারণ, সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে অভিযোগ থাকলে একটি নির্ধারিত দেশ সফরের পর জাতিসংঘের ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে, যাতে সদস্য দেশের প্রবল সমালোচনা হয়। আর এ বিষয় মাথায় রেখেই জাতিসংঘের বিশেষায়িত কমিটির সফরের অনুরোধ সচরাচর উপেক্ষা করা হয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক কমিটির প্রতিবেদনের প্রভাব নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে যা আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে গুম নিয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রকাশ্যে আসবে, সমালোচনা হবে। তবে এ কারণে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা হবে, এমন সুযোগ নেই। কারণ, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কিছু করার এখতিয়ার নেই।