সব জলাভূমির সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য অনতিবিলম্বে পৃথক মন্ত্রণালয়, তথা ‘জলাভূমি মন্ত্রণালয়’ সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে হাইকোর্টের এক রায়ে। ‘জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন’ দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে বলেও রায়ে এসেছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নে ইউনিক প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিডেটের সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি ও সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের মাটি ভরাট কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে এমন নির্দেশনা রয়েছে। গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১৩২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়।
রায়ে বলা হয়, যেহেতু বাংলাদেশ ‘রামশার কনভেনশন’ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে, সেহেতু ওই অঙ্গীকার ও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্রুত নীতিমালা গ্রহণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনগত দায়িত্ব-কর্তব্য।
পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়টি মৌজায় কৃষিজমি, নিচু ভূমি ও জলাভূমিতে মাটি ভরাট অবৈধ ঘোষণা করে গত বছরের ২ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্দেশনাসহ ওই রায় দেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করে কোনো উন্নয়নই স্থায়ী হয় না। বরং প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের রক্ষণ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, তা দীর্ঘমেয়াদি সাম্য, সম্প্রীতি ও শান্তি আনয়ন করে।
ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যে ছয়টি মৌজায়, সেগুলো হলো পিরোজপুর, জৈনপুর, ছয়হিস্যা, চরভবনাথপুর, ভাটিয়াবান্দা ও রতনপুর। ইউনিক প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর আলী, যিনি রিটে ১১ ও ১২ নম্বর বিবাদী (প্রতিপক্ষ)।
রায় ও আদালতের নির্দেশনা
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘তুরাগ নদী’ রায় অনুসারে সব জলাভূমি পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি, তথা জনগণের ন্যায্য সম্পত্তি, তথা জাতীয় সম্পত্তি।
রায়ে বলা হয়, ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষ কর্তৃক নারায়ণগঞ্জের ওই ছয় মৌজার কৃষিজমি, নিচু ভূমি ও জলাভূমি কী পরিমাণ দখল ও বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, তার পরিমাণ ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করার জন্য যৌথভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
অপর নির্দেশনায় বলা হয়, রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত সাপেক্ষে সোনারগাঁ উপজেলার ওই ছয়টি মৌজায় বালু দিয়ে ভরাট করা কৃষিজমি, নিচু ভূমি ও জলাভূমি ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষের খরচে পুনরুদ্ধার করে আগের অবস্থায় ফেরত আনতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায়ে বলা হয়, রায় পাওয়ার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষ কর্তৃক বালু দিয়ে জনগণের কৃষিজমি ভরাটের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ১১ ও ১২ নম্বর প্রতিপক্ষ থেকে আদায় করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
আদালত বলেছেন, ২০১০ সালের অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনের ৩৩ ধারা বিধানমতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আবেদন করতে ইচ্ছুক হলে আবেদনপত্রের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক।
হাইকোর্ট সরকারি–বেসরকারি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই মাস অন্তর এক দিন এক ঘণ্টাব্যাপী জলাভূমির প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা, রক্ষা ও দূষণ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্লাস নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ অনুসারে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্লাস নিচ্ছে কি না, তা তদারক করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া হাইকোর্ট প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও জেলায় প্রতি তিন মাস অন্তর এক দিন জলাভূমির প্রয়োজনীয়তাবিষয়ক দিনব্যাপী র্যালি, চিত্র প্রদর্শনী, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা, আলোচনা ও সেমিনার করতে সব ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, এই রায়ের অনুলিপি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য পাঠানো হোক, যাতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের সব জলাভূমি রক্ষায় জরুরিভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে পারেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ওই ছয় মৌজার কৃষিজমি, জলাভূমি ও মেঘনা নদীর অংশবিশেষ ভরাট করে ইউনিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। এ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালে রিট করে বেলা। শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২ মার্চ হাইকোর্ট রুল দেন। ইউনিক প্রপার্টিজকে ওই এলাকায় মাটি ভরাট কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপর সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের জন্য প্রাক্-যোগ্যতার অনুমোদন পেয়েছে জানিয়ে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড হাইকোর্টের আগের আদেশ সংশোধন চেয়ে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞার আদেশ সংশোধন করে কার্যক্রম পরিচালনার আদেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে বেলা আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এর আগে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার আদেশ বহাল রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ২ ডিসেম্বর রায় দেওয়া হয়।
আদালতে বেলার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মিনহাজুল হক চৌধুরী, আলী মুস্তফা খান ও সাঈদ আহমেদ কবীর। সোনারগাঁ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুরাদ রেজা ও আহসানুল করিম। ইউনিক প্রপার্টিজ লিমিডেটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আবু তালেব।