জরুরি গর্ভনিরোধক: পদ্ধতি, কার্যকারিতা ও ঝুঁকি

প্রতীকী ছবি

অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ থেকে পরিত্রাণের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো জরুরি গর্ভনিরোধক, যা সঠিক সময়ের মধ্যে গ্রহণ করলে গর্ভাবস্থার ঝুঁকি রোধ করা যায় এবং অনেক দম্পতির কাছে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হয়। নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, অরক্ষিত শারীরিক সম্পর্কের পর এ পদ্ধতিগুলো খুব দ্রুত ব্যবহার করতে হয়। জরুরি গর্ভনিরোধক গর্ভধারণ রোধ করে, তবে গর্ভপাত বা অ্যাবরশন ঘটাতে সাহায্য করে না। তাই গর্ভধারণের পরে এই ব্যবস্থা নিলে কোনো লাভ হবে না।

জরুরি গর্ভনিরোধক পদ্ধতি

প্রাথমিকভাবে জরুরি গর্ভনিরোধের দুটি পদ্ধতি আছে। ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ পিল বা মর্নিং আফটার পিল। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ঝুঁকি রোধে বহুল ব্যবহৃত অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি হলো ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ পিল (ইসিপি), যা ওভার দ্য কাউন্টার (ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কেনা যায় এমন) ওষুধ হিসেবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অরক্ষিত শারীরিক সম্পর্কের ৭২ (তিন দিন) থেকে ১২০ (পাঁচ দিন) ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করা যায়। ইসিপি ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি দেয় না। তাই এই পিল খাওয়ার পরও অন্তঃসত্ত্বা বা প্রেগন্যান্ট হতে পারে।

কপার আইইউডি

সবচেয়ে কার্যকর (৯৯%) জরুরি গর্ভনিরোধক পদ্ধতি হলো কপার আইইউডি, যা অসুরক্ষিত শারীরিক সম্পর্কের পাঁচ দিনের মধ্যে গ্রহণ করা যেতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে ১০ বছর পর্যন্ত গর্ভধারণ রুখতে পারে।

জরুরি গর্ভনিরোধক কীভাবে কাজ করে

  • ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হয়ে জরায়ুতে আসতে বাধা দেয় বা বিলম্বিত করে।

  • ডিম্বাণু শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হতে পারে না।

  • জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের পরিবর্তন করে নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুতে প্রথিত (ইমপ্ল্যান্ট) হতে দেয় না।

  • কপার আইইউডি শুক্রাণুকে ডিমে পৌঁছানোর পক্ষে কঠিন করে এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুতে ইমপ্ল্যান্ট হতে বাধা দিয়ে গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে।

জরুরি গর্ভনিরোধক কখন খাবেন

  • সম্মতি ব্যতিরেকে জোর করে অরক্ষিত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হলে।

  • সহবাসের সময় কনডম ফেটে গেলে।

  • ডায়াফ্রাম বা সার্ভাইক্যাল ক্যাপের স্থানচ্যুতি হলে।

  • পর পর দুদিন খাবার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (ওসিপি) খেতে ভুলে গেলে।

  • যদি ইনজেকশনের পরবর্তী ডোজ নিতে ২৮ দিনের বেশি দেরি হয়ে যায়।

  • নিরাপদকাল গণনায় ভুল হলে।

কারা ব্যবহার করতে পারবেন না

  • যাঁরা ইতিমধ্যে গর্ভধারণ করেছেন।

  • যাঁরা প্রায়ই অরক্ষিত সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁদের নিয়মিত গর্ভনিরোধক পদ্ধতি হিসেবে বারবার ইসিপি ব্যবহার করা উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে গর্ভধারণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হলো কপার আইইউডি ব্যবহার করা।

  • যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের, পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ (পিআইডি), সার্ভাইক্যাল ক্যানসার, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, লিভার ডিজিস নারীদের আইইউডি ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

১. জরুরি গর্ভনিরোধক সাধারণত নিরাপদ, তবে এ পিল সেবনে কারও কারও স্বল্পস্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন—

  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।

  • মাথাব্যথা।

  • মাথা ঝিমঝিম করা।

  • অবসন্নতা।

  • স্তনে ব্যথা।

  • মাসিকের সমস্যা (অনিয়মিত মাসিক)

২. কপার আইইউডি ব্যবহারের ক্ষেত্রে—

  • পেটে ব্যথা।

  • মাসিকের সময় ব্যথা।

  • জরায়ুতে প্রদাহ।

  • অতিরিক্ত সাদা স্রাব হওয়া।

  • মাসিকের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে ভারী রক্ত প্রবাহ।

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে

  • পিরিয়ড না হলে বা গর্ভধারণ সন্দেহ হলে।

  • তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হলে।

  • অনিয়মিত রক্তপাত হলে।

  • জ্বর, বিশেষ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হলে।

  • অতিরিক্ত স্রাব বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব হলে।

  • যৌন সম্পর্ক স্থাপনকালে ব্যথা অনুভূত হলে।

যেসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে

ইসিপিকে মর্নিং আফটার পিল বলা হয়ে থাকে বলে অনেকে বিভ্রান্তিতেও পড়েন। মনে করেন, সকালে খেলেই হবে। কিন্তু অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের পর এই পিল যত দ্রুত খাওয়া হবে, ততই ভালো কাজ করবে।

পিল খাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে বমি হলে আরেকটি পিল খেতে হবে। তবে দুই ঘণ্টা পার হওয়ার পর বমি হলে পুনরায় পিল সেবনের প্রয়োজন নেই।

ইসিপি কোনো পরিবার পরিকল্পনার নিয়মিত পদ্ধতি নয়। এটি শুধু জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।

জরুরি গর্ভনিরোধক যৌন সংক্রমণজনিত রোগ থেকে রক্ষা করে না।

একই মাসে একাধিকবার ইসিপি ব্যবহারে যদিও স্বাস্থ্যগত কোনো ক্ষতি নেই। তবে এই পিল ঘন ঘন ব্যবহার করলে অতিরিক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (অনিয়মিত রক্তস্রাব, মাথাব্যথা) হতে পারে।

নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ইসিপির কার্যকারিতা কমাতে পারে। যেমন অ্যান্টিটিবি (রিফামপিসিন), অ্যান্টিফাংগাল (গ্রাইসিওফালভিন), অ্যান্টিএপিলেপটিক (খিঁচুনি প্রতিষেধক), এইচআইভির ওষুধ। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জরুরি গর্ভনিরোধনের ব্যবস্থা গ্রহণকালে অসুস্থ অনুভব করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রতিটি ওষুধের ক্ষেত্রবিশেষে বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই জরুরি গর্ভনিরোধক ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনার সুযোগ থাকলেও এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সুবিবেচিত হতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

ডা. সানজিদা মাহমুদ : কনসালট্যান্ট (অবস অ্যান্ড গাইনি), সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ফুলবাড়িয়া, ঢাকা