পথশিশুদের বিশ্বকাপ

জন্মসনদ পেতে জটিলতা

মা–বাবার জন্মসনদ ছাড়া পথশিশুদের জন্মসনদ মিলছে না। বিশ্বকাপে লাল–সবুজের প্রতিনিধিত্ব করা নিয়ে সংশয়।

কাতারে পথশিশুদের বিশ্বকাপে অংশ নিতে অনুশীলনে ব্যস্ত শিশুরা
ছবি: সংগৃহীত

কাতারের রাজধানী দোহায় এ বছরের অক্টোবরে পথশিশুদের বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে। শুধু মেয়েদের এই আসরে অংশ নেবে ২১টি দেশ। সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ১০ পথশিশু মেয়েকে ৫ মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কাতারে যাওয়ার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে দরকার জন্মনিবন্ধন সনদ। তবে মা–বাবার খোঁজ না থাকায় এই শিশুদের তিনজনের জন্মসনদপ্রাপ্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। ওই শিশুদের মা–বাবার জন্মসনদ চাইছে প্রশাসন।

১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী ওই ১০ শিশু বাংলাদেশ লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লিডো) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে। এটি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার তারানগর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) অবস্থিত। শিশুদের প্রশিক্ষণে সহায়তা দিচ্ছে স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

লিডো জানিয়েছে, এর আগে মা–বাবার জন্মসনদ প্রয়োজন না হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের জন্মসনদ পেতে এতটা ঝক্কি পোহাতে হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে সাত পথশিশুর জন্মসনদের আবেদন করা হয় ইউপি কার্যালয়ে। এর মধ্যে তিনটি মেয়েশিশু রয়েছে, যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বিশ্বকাপের জন্য। বাকি চার ছেলেশিশুকে স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ লাগছে। লিডো জানিয়েছে, বিশ্বকাপে ১০ মেয়েশিশুকে পাঠানো হবে, এর মধ্যে ৭ জনের জন্মসনদ আছে। এ বছরের নভেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ৫-১৫ অক্টোবর একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্ট্রিট চাইল্ড ওয়ার্ল্ডকাপ ২০২২’। আন্তর্জাতিক সংগঠন স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড এর আয়োজক। সহায়তা দিচ্ছে কাতার সরকার ও ফিফা।

আবেদন সম্পর্কে তারানগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের দিক দিয়ে জন্মসনদ দেওয়ার সুপারিশ করে ইউএনও কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি (১৭ জানুয়ারি)।’

গত সোমবার যোগাযোগ করা হলে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, পথশিশুদের ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা লিখলে তাঁরা সেই হিসেবে অগ্রসর হতে পারতেন। আবেদনপত্রে মা–বাবার নাম দেওয়া বলে জন্মসনদ চাওয়া হচ্ছে। তিনি করণীয় জানতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে অবহিত করেছেন।

ছয়–সাত বছর আগে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় ওই শিশুদের বয়স ছিল সাত-আট বছর। ওই শিশুরা তখন মা–বাবার নাম বলতে পারায় আবেদনপত্রে নাম উল্লেখ করা হয় বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন লিডোর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মো. ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, এই শিশুদের স্কুলে ভর্তির জন্যও জন্মসনদ লাগবে। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান দরকার।

স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের (শি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রশিক্ষণের সময় এই শিশুদের মধ্যে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। জন্মনিবন্ধন সনদের কারণে বিশ্বকাপে তাদের অংশগ্রহণ আটকে গেলে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। পথশিশুদের জন্মনিবন্ধনের স্থায়ী সমাধানের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরকে অভিভাবক হিসেবে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

বাবার খোঁজ নেই, সনদ পেতে ভোগান্তি

স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ২০০৬ সালে ছয় মাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে আসেন এক নারী। ২০০৯ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর মেয়ে বড় হয় খালা-খালুর কাছে। মেয়েটি এখন রাজধানীর একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। ২০১১ সালে মেয়েটির মা–বাবার নাম দিয়েই তার জন্মসনদ করা হয়। মেয়েটির খালু প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর শিক্ষার্থীদের টিকাদান শুরু হলে পুরোনো (ম্যানুয়েল) জন্মসনদ দিয়ে টিকার জন্য আবেদন করতে পারছিলেন না। ডিজিটাল জন্মসনদের জন্য তিনি জন্মনিবন্ধন কার্যালয়ে গেলে তারা নতুন করে জন্মসনদ নিতে বলে এবং মা–বাবার জন্মসনদ চায়। খালু জানান, মেয়েটির মায়ের জন্মসনদ আছে। বাবারটা তাঁদের কাছে নেই। তাঁরা জানেনও না বাবা কোথায় থাকে, কী করেন। পুরোনো জন্মসনদ দিয়ে টিকা দেওয়া গেলেও ভবিষ্যতে পাসপোর্ট করাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মেয়েটির জন্মসনদ লাগবে। তাই একটি জন্মসনদ পেতে তিনিও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল পলাশ কান্তি বালা প্রথম আলোকে বলেন, পথশিশুদের জন্মনিবন্ধনে আইনগত কোনো বাধা নেই। বিধি অনুসারে যে কাজটি যে ধাপে প্রতিপালন করার কথা, তা করা হচ্ছে না। এটা মাঠপর্যায়ের নিবন্ধকের কাজ। নিবন্ধক তাঁর এলাকায় বসবাসরতদের আবেদন যাচাইয়ে ব্যবস্থা নেবেন।