টাঙ্গাইল শহরে তারাপদ রায়ের পৈতৃক ভিটার চিহ্ন এখন আর নেই। বাড়ির সামনের পুকুরটি ‘কবি তারাপদ সরোবর’ নামকরণ করার দাবি।
বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে টাঙ্গাইলের পরিচিতি মেলে কবি তারাপদ রায়কে দিয়ে। তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ চারাবাড়ি পোড়াবাড়িসহ বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি টাঙ্গাইলের কথা। টাঙ্গাইলের জন্য, এখানকার মানুষের জন্য তাঁর টান ছিল আমৃত্যু। অথচ টাঙ্গাইলে এখন খুঁজে পাওয়া যায় না তারাপদ রায়ের কোনো স্মৃতিচিহ্ন।
আজ ২৫ আগস্ট তারাপদ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায় ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সুধীর রায়, মা রেনুকা রায়। বাবা এবং দাদু লগনচাঁদ রায় ছিলেন টাঙ্গাইল আদালতের প্রখ্যাত আইনজীবী।
স্ত্রী মিনতী রায়, ছেলে কৃত্তিবাস রায়সহ তারাপদ রায় ১৯৮২ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে এসেছিলেন। তখন টাঙ্গাইলের সাহিত্যপ্রেমীরা সুধীর রায়, তারাপদ রায়, কৃত্তিবাস রায়কে নিয়ে ‘তিন পুরুষের কবিতা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন শহীদ মিনার চত্বরে।কবি মাহমুদ কামাল, সাধারণ সম্পাদক, টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের
শহরের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তারাপদ রায়। তারপর পাড়ি জমান কলকাতায়। ভর্তি হন মাওলানা আজাদ কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করেন। প্রথমে শিক্ষকতা করলেও পরে যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সচিব পদ থেকে অবসর নেন তিনি।
কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি কবি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। একপর্যায়ে বাংলার প্রসিদ্ধ কবি, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে জায়গা করে নেন। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তিনি ‘গ্রন্থকীট’ ও ‘নক্ষত্র রায়’ ছদ্মনামেও লিখতেন। পেয়েছেন শিরোমণি পুরস্কার ও কথাসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫)।
সরকারি এমএম আলী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শামসুল হুদা জানান, কলকাতায় চলে যাওয়ার পরও তারাপদ রায় দু-চার বছর পরপর আসতেন প্রিয় শহর টাঙ্গাইলে। তাঁর বাবা সুধীর রায় আশির দশকের মাঝামাঝিতে মারা যান। বাবা বেঁচে থাকতেই বিশাল বাড়ির বিভিন্ন অংশ বিক্রি করেন। শেষ পর্যন্ত মূল ভিটা ছিল, সেখানে দালানগৃহে বাস করতেন তারাপদ রায়ের ছোট ভাই বাচ্চু রায়। মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চু বাবার
মৃত্যুর পর ভিটেবাড়ির শেষ অংশটুকু বিক্রি করে চলে যান। এখন তারাপদ রায়ের পিতৃভিটায় উঠেছে বড় বড় দালান। তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই ‘খুঁজে না পাওয়ার’ হতাশার চিত্র পাওয়া যায় কবির কবিতাতেও। ‘পুরোনো শহরতলিতে’ কবিতায় তিনি লেখেন—
মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম-কাঁঠালগাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘরদোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, ‘নাগরিক’।
চারতলা বাড়ি, ষোলোটা ফ্ল্যাট।
কবিতার শেষটায় তিনি লেখেন—
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরোনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।
টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক কবি মাহমুদ কামাল তারাপদ রায়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, কলকাতা থেকে টাঙ্গাইল এলেই তিনি তাঁর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। সবার খোঁজখবর রাখতেন। তাঁর বাবা সুধীর রায়েরও সন্ধ্যা মালতী নামে একটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। তারাপদ রায়ের ছেলে কৃত্তিবাস রায় ওরফে তাতাইও কবিতা লিখতেন। স্ত্রী মিনতী রায়, ছেলে কৃত্তিবাস রায়সহ তারাপদ রায় ১৯৮২ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে এসেছিলেন। তখন টাঙ্গাইলের সাহিত্যপ্রেমীরা সুধীর রায়, তারাপদ রায়, কৃত্তিবাস রায়কে নিয়ে ‘তিন পুরুষের কবিতা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন শহীদ মিনার চত্বরে। এরপরও তারাপদ রায় একাধিকবার টাঙ্গাইলে এসেছেন। সর্বশেষ এসেছিলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। সে সময় শেষবারের মতো দেখে গেছেন পৈতৃক বাড়ি। তত দিনে তাঁর স্মৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।
অবসর গ্রহণের পর তিনি কলকাতাতেই বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি ২০০৭ সালের ২৫ আগস্ট মারা যান।
লেখক ও ছড়াকার হুমায়ুন তালুকদার বলেন, তারাপদ রায়ের পৈতৃক ভিটার স্মৃতিচিহ্ন এখন আর নেই। তাঁদের ভিটায় এখন বড় বড় অট্টালিকা। তবে তাঁদের বাড়ির সামনে রয়েছে পৌরসভার মালিকানাধীন একটি পুকুর। পুকুরটি পৌর কর্তৃপক্ষ দৃষ্টিনন্দন করে সংস্কার করেছে। এটি ‘কবি তারাপদ সরোবর’ নামকরণ করে সেখানে তাঁর প্রতিকৃতি ও সংক্ষিপ্ত জীবনীসংবলিত শিলালিপি স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এতে একদিকে কবির স্মৃতির প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো হবে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম জানা যাবে তারাপদ রায় সম্পর্কে।