জনসমাগমস্থলে ৮২% নারী যৌন হয়রানির শিকার

পারিবারিক বলয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর জনসমাগমস্থল—এ পাঁচ ক্ষেত্রে জরিপটি করা হয়।

সূত্র: প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

দেশের রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন। তবে এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে ৩ শতাংশের কম (২.৯%)। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। তবে এ জরিপ অনুসারে নারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে পারিবারিক বলয়ে, ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন হয়রানি–নিপীড়নের শিকার নারীদের অনেকে মানসিক অবসাদে ভোগেন, আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ভীত হয়ে পড়েন, অসুস্থ হয়ে পড়েন, লেখাপড়ায় মনোযোগ হারান। এমনকি পরীক্ষায় অকৃতকার্যও হন কেউ কেউ।

পারিবারিক বলয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর জনসমাগমস্থল—এ পাঁচ ক্ষেত্রে জরিপটি করা হয়েছে। এ অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ৫৭ শতাংশ আর কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ৫৬ শতাংশ নারী।

আজ ২৫ নভেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন উপলক্ষে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, সহিংসতার ভয়ের কারণে মেয়েরা চাকরি ও পেশা নির্ধারণে নানা রকম চাপের মুখে থাকেন। সহিংসতার ভয় মেয়েদের বেড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এটা বাল্যবিবাহও বাড়ায়।

গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত আটটি বিভাগের শহর ও গ্রামের ৪ হাজার ৩০৫টি পরিবারের ওপর জরিপটি করা হয়। এতে অংশ নেন ৮ হাজার ৮৫৪ জন। এর মধ্যে ১৫–২৪ বছর বয়সী ২ হাজার ২৩২ জন কিশোরী–তরুণী, ২ হাজার ২০৮ জন তরুণ, ২ হাজার ২১৭ জন মা এবং ২ হাজার ১৯৭ জন বাবা।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের নীতি নির্ধারণ ও তথ্য বিশ্লেষণে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্‌নাজ হুদা বলেন, সহিংসতার শিকার হওয়ার শঙ্কার প্রভাব কতখানি গুরুতর, তা মেয়েদের জীবনযাপন প্রক্রিয়াকে কীভাবে সংকুচিত করে, মানসিক শক্তি ক্ষয় করে, সম্ভাবনা নষ্ট করে, তা–ও এ জরিপে দেখানো হয়েছে।

‘সেদিনের ঘটনা এখনো চোখে ভাসে’

ঘটনাটি তিন বছর আগের। রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় রাজধানীর মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন একজন নারী সাংবাদিক। তখন একটি ছেলে তাঁর গা ঘেঁষে হাঁটছিল, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করছিল। তিনি প্রতিবাদ করলে ছেলেটি অশোভন কথা বলতে শুরু করে। আশপাশের লোকজন ছেলেটিকে না থামিয়ে উল্টো তাঁকে বলেন, ‘আপা, আপনি মেয়েমানুষ, চুপ থাকেন।’ এতে ক্ষোভে–দুঃখে নিজেকে সামলাতে না পেরে একপর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন ওই নারী সাংবাদিক। গত মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো রাতে যদি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে হয়, সেদিনের ঘটনা চোখের সামনে ভাসতে থাকে।’

যৌন হয়রানি

২০ নভেম্বর কলেজে যাওয়ার পথে অর্ধেক ভাড়া দিতে চাওয়ায় বাসচালক ও চালকের সহকারীর অশোভন আচরণের শিকার হন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রী। এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক কৃষ্ণপদ মজুমদার বলেন, ‘এত বড় ঘটনা, মেয়েটি খুব ভয় পেয়েছে।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

সহিংসতার ভয়ের প্রভাব

জনসমাগমস্থলে সহিংসতার শিকার ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী-তরুণী জানান, তাঁরা মানসিক বিষাদে ভোগেন। পারিবারিক বলয়ে সহিংসতার ভয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াতে ভয় পান ৮০ শতাংশ নারী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহিংসতার শিকার ছাত্রীদের ৯০ শতাংশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, হতাশায় ভোগে, একা থাকতে চায়। কেউ কেউ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে। কর্মক্ষেত্রে হয়রানির পর কাজে যাওয়া বন্ধ করেন ২৬ শতাংশ নারী। অনলাইনে হয়রানির শিকার মেয়েদের ৭৮ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন।

জরিপের তথ্য বলছে, জনসমাগমস্থলে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে লোকজনের সাহায্য চান ৪৪.১ শতাংশ নারী, প্রতিবাদ করেছেন ৪৩.৪ শতাংশ, নীরব থেকেছেন ৩৫.৯ শতাংশ, পুলিশকে জানান ৯.৩ শতাংশ এবং ‘৯৯৯’ বা ‘১০৯’ নম্বরে ফোন করেন ৩.৩ শতাংশ নারী। এ ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে ২.৯ শতাংশ।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস হাব) কাশফিয়া ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, সহিংসতার ভয়ের কারণে মেয়েরা চাকরি ও পেশা নির্ধারণে নানা রকম চাপের মুখে থাকেন। সহিংসতার ভয় মেয়েদের বেড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করে। এটা বাল্যবিবাহও বাড়ায়।