নারীরা মাথা আঁচড়ানোর পরই উঠে আসা চুল ফেলে দেন। আবার অনেকে জমান। আর সেই জমানো চুল কেনেন ফেরিওয়ালারা। সেই চুলে ভাগ্য বদলে যাচ্ছে হাজারো মানুষের।
সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গায় গড়ে উঠেছে শতাধিক চুলের কারখানা। এসব কারখানাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো নারী-পুরুষের। বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন অর্ধশত প্রতিবন্ধীও। পাল্টে গেছে এলাকার তরুণদের ভাগ্য। কে জানত নারীদের ফেলে দেওয়া মাথার চুলই হবে হাজারো নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, পাল্টে দেবে ভাগ্য।
বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা, বাদাম, প্রসাধনসামগ্রী ও বেলুনের বিনিময়ে শহর ও গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল (গুটি) সংগ্রহ করেন এলাকায় ফেরিওয়ালারা। তাঁরা সংগ্রহ করা চুল কারখানাগুলোয় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এরপর গুটি চুলগুলো কারখানার নারী কর্মীরা বাছাই করেন। চলে ওয়াশ। এরপর প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন দিয়ে আকারভেদে পৃথক করে রাবার ও সুতা দিয়ে বাঁধেন কর্মীরা। এভাবেই প্রসেসিং শেষে কার্টুন করা হয়। ইঞ্চিভেদে দাম ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা হয়ে থাকে। প্রক্রিয়াজাত এ চুল যাচ্ছে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, আমেরিকা, ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলের ক্ষুদ্র এই জেলা থেকেই বছরে রপ্তানি আয় হচ্ছে শত কোটি টাকার চুল। ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হচ্ছে এলাকার নিম্নশ্রেণির মানুষের। চুয়াডাঙ্গার প্রায় প্রতিটি গ্রামে চুলের কারখানা গড়ে তুলেছেন স্থানীয় লোকজন। প্রতিটি কারখানায় কাজ করে গ্রামের দরিদ্র নারীরা। বিনিময়ে প্রতি মাসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে, কারখানায় কর্মরত কারিগরেরা দক্ষতা অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কুতুবপুর গ্রামের কয়েকজনের মাধ্যমেই এক দশক আগে দার উন্মোচিত হয়েছিল পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসার। শুরুটা কয়েকজনের মাধ্যমে হলেও এখন ব্যবসায়ীর সংখ্যা কয়েক শ।
শুরুর দিকে ব্যবসায়ীরা কোনো প্রসেসিং ছাড়াই অবৈধভাবে ভারত ও মিয়ানমারে চুল পাচার করতেন। ব্যবসাটি বেশ লাভজনক হওয়ায় সবার চাওয়া ছিল রাষ্ট্র বৈধতা দিক। বৈধভাবে করার লক্ষ্যে জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমবায় অধিদপ্তরসহ সব বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে সেমিনার আয়োজন করেন ব্যবসায়ীরা। সেমিনারে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলে ব্যবসাটি পায় বৈধতা। বিশ্বায়নের এ যুগে ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ শুরু করেন চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডের চুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তাঁদের বাংলাদেশ থেকে চুল ক্রয় করার আহ্বান জানানো হয়। বিদেশিরা এ দেশে এসে মানসম্মত চুল দেখে কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশে সব সময়ের জন্য অর্ধশত চীনা চুল ব্যবসায়ী অবস্থান করেন, যাঁরা এ দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি চুল কেনেন। ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটেছে পুরো চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায়। এসব এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন চুলের কারখানা। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে ঝুঁকছেন এ ব্যবসায়। যুক্ত হচ্ছেন এলাকার শিক্ষিত বেকাররাও। চুল ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একতা হেয়ার প্রসেসিং সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠনও।