জনপ্রশাসনে সচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। নতুন সচিব পদে যাঁদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা; তাঁদের আশঙ্কা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুবিধা পেয়ে পুরোনোদের কেউ কেউ রয়ে যাবেন। ফলে অন্যরা বঞ্চিত হবেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভায়ও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। একজন জ্যেষ্ঠ সচিব এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কর্মকর্তাদের ফেসবুক গ্রুপে পোস্টও দিয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ডিসেম্বরে নয়জন সচিব অবসরে যাবেন। আগামী দুই মাসে আরও নয়জনের অবসরে যাওয়ার কথা। এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে সক্রিয় রয়েছেন। এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদসচিব আনোয়ারুল ইসলামকে ১৬ ডিসেম্বর থেকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর নিয়মিত অবসরে যাওয়ার তারিখ ১৫ ডিসেম্বর।
উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে পদের চেয়ে চার গুণ বেশি কর্মকর্তা আছেন। যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়েও পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়তে থাকলে এসব কর্মকর্তার শীর্ষ পদে যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্যও করতে পারেন না।
জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে ১৮ জন সচিব অবসরে যাবেন। তাঁদের মধ্যে ২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জুয়েনা আজিজ, জনপ্রশাসনসচিব ফয়েজ আহম্মদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রইছউল আলম মণ্ডল। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আখতার হোসেন ভূইয়ার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ৩০ ডিসেম্বর। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২ জানুয়ারি।
৫ থেকে ১০ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার তালিকায় আছেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান ও ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুল হান্নান।
৯ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাবেন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত সচিব) মো. ফারুক হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম আরিফ উর রহমান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মনোয়ার আহমেদ।
বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও দূতাবাস মিলিয়ে দেড় শতাধিক কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পরিহার করে একটি নীতিমালা প্রণয়নে ২০১৪ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন। যে কর্মকর্তাদের অবসরে যাওয়ার পরও সরকার কাজে লাগাতে চায়, তাঁদের ক্যাডারবহির্ভূত বিশেষ পদে নিয়োগ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই চিঠি আমলে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে দেওয়া পে-কমিশনের সুপারিশেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ওই সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কিছুটা কমেছিল। পরবর্তীতে আবার বেড়ে যায়।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি অনেক যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না পান। অন্যদের হতাশ করে প্রধানমন্ত্রী কিছু করবেন না।’
২০১৭ সালে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অষ্টম সভায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। ওই সভায় অনেকে কারণ ব্যতীত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান না করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার কথাও বলেছিলেন। পরে দেখা গেছে, এঁদের কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি হলেন স্থানীয় সরকারসচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একজন কর্মকর্তার চাকরি শেষ হলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি অবসরে যাবেন। তাঁর যোগ্যতা বা দক্ষতা বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কাউকে রাখার দরকার হলে তিনি থাকবেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। এটা পুরোটাই রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়। অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁরা এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করতে পারেন না। তাঁরা শুধু কর্মকর্তাদের কল্যাণের বিষয়টি দেখেন।
তবে অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক গ্রুপে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তিনি এক পোস্টে লিখেছেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে অনেক দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলতি বছর এবং ২০২০ সালে চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হবে এমন অনেক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য অপতৎপরতা চালাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কবির বিন আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের গ্রুপে মন্তব্য করেছি, সেটা আপনারা জানলেন কী করে? আমি এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই।’
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগে কোনো প্রকল্প বা বিশেষ কারণে এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হতো। এখন সচিব পদে এক থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষে কারও কারও চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া দুই বছর করে মোট চার বছরের চুক্তিতে আছেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহাবুব আহাম্মেদ দুই বছরের জন্য চুক্তিতে, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে হোসনে আরা বেগম দুই বছর করে চার বছরের চুক্তিতে রয়েছেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দুই বছর করে চার বছরের চুক্তিতে আছেন পবন চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে পাঁচ বছরের চুক্তিতে আছেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে দুই বছর করে দুই দফায় চার বছর চুক্তিতে কাজ করছেন মো. শহীদ উল্লা খন্দকার। ইতালিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুই বছরের চুক্তিতে আছেন সাবেক সচিব আবদুস সোবহান শিকদার। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছর ধরে চুক্তিতে আছেন নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ‘বিকল্প নির্বাহী পরিচালক’ পদে তিন বছরের চুক্তিতে আছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম দুই বছরের চুক্তিতে, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম তিন বছরের চুক্তিতে, পিএসসির সদস্য পদে এস এম গোলাম ফারুক পাঁচ বছরের চুক্তিতে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার পদে তিন বছরের চুক্তিতে আছেন সুব্রত রায় মৈত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যাঁরা সচিব পদপ্রার্থী, তাঁদের হতাশার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তাকে সরকার অবশ্যই কাজে লাগাতে পারে। তবে তাঁকে আলাদা পদ দিয়ে অথবা উপদেষ্টা করে রাখতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যা হতাশাজনক।