পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তিসহ নানা ধরনের উন্নয়নকাজে ২৭টি প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার (১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রায়) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন। এর মধ্যে তিন বছর পার হয়েছে। কিন্তু মাত্র পাঁচটি প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ঋণচুক্তি সই হয়েছে। চীন এ পর্যন্ত অর্থ দিয়েছে ৯৬ কোটি ডলার (৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা), যা প্রতিশ্রুত অর্থায়নের ৫ শতাংশের কম।
২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ওই ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত হয়। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। হাতে সময় আছে মাত্র ১৪ মাস। এসব প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়টি কীভাবে সুরাহা করা যায়, তা ঠিক করতে দুই দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) এই মাসেই ঢাকায় আলোচনায় বসার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২৭টি প্রকল্পে কেন দেরি হচ্ছে, এর কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় সুপারিশের জন্য গত জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় জেডব্লিউজি গঠন করা হয়েছিল। আশা করা যায়, জেডব্লিউজির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ভারতের সঙ্গে ঋণ চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের জেডব্লিউজি গঠন করা হয়েছিল। পরে ওই কমিটির সুপারিশ ভারতের সঙ্গে ঋণ চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা আগের চেয়ে কমেছে।
ঢাকা ও বেইজিংয়ে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলছেন, প্রকল্পগুলোতে ধীরগতির জন্য দুই দেশের আমলাতন্ত্রের দায় আছে। বাংলাদেশে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির মতামত নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে চীন যদি প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথির কোনো বিষয় বুঝতে না পারে, তবে তা নতুন করে জানাতে বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠায়। পাশাপাশি এ ধরনের প্রকল্পে কাজ পেতে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুই দেশে তদবির চালাতে থাকে। এটিও প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। সবশেষে পুরো প্রক্রিয়া শেষে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে চীন সময় নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ২৭টি প্রকল্পের মধ্যে এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি তেলের পাইপলাইন ও ‘মুরিং’ স্থাপন, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় ধাপের উন্নয়ন এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন—এই ৫ প্রকল্পের জন্য ৪২৬ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে চীন এখন পর্যন্ত দিয়েছে ৯৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে পদ্মার রেল সংযোগের জন্য ৫৩ কোটি, কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণের জন্য ১৯ কোটি, জ্বালানি তেলের পাইপলাইনের জন্য ৮ কোটি, তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তৃতীয় ধাপের উন্নয়নে ১২ কোটি ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়নে ৪ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে।
>চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প চূড়ান্ত হয়
২৭ প্রকল্পে ২ হাজার কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা চীনের
প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে
৩ বছরে কেবল ৫টি প্রকল্পে ৯৬ কোটি ডলার দিয়েছে চীন
এর বাইরে বাকি ২২ প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি নেই। তার মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামোর সাতটি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে ছয়টি এবং বাকিগুলো স্থানীয় সরকার, তথ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির প্রকল্প রয়েছে।
ইআরডির উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, চলতি মাসে অনুষ্ঠেয় জেডব্লিউজির বৈঠকে বাংলাদেশ অন্তত ১০টি প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের তাগিদ দেবে। এর মধ্যে ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ছয়টি পূর্ণাঙ্গ টিভি কেন্দ্র স্থাপন ও বিজেএমসির আওতায় থাকা সরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন অন্যতম।
এ বিষয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে। তাঁর মতে, চীন চাইবে এখানে অর্থায়নের বিনিময়ে যত বেশি সম্ভব সুফল আদায় করতে। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে চীনের অর্থায়নের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণসুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
তবে বড় প্রকল্পের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, এমন এক সাবেক কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলে স্বাভাবিকভাবেই খরচ বেড়ে যায়। কখনো কখনো নতুন করে দর-কষাকষি করার বিকল্প থাকে না। তাই নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকায় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর দুই দেশ ২৭টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও বাণিজ্যিক পত্র সই করেছে। এর মধ্যে ১৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ঋণ ও অর্থায়ন বিষয়ে ১১টি বাণিজ্যিক চুক্তি বা পত্র সই হয়েছে। একই বিষয়ে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। ওই ১৬ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অন্যতম হচ্ছে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের সামর্থ্য বাড়াতে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এমওইউ। ওই সমঝোতা স্মারকের আওতায় ২ হাজার কোটি ডলারের ২৭টি বিনিয়োগ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়।
বড় অবকাঠামোবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এম ফওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন বিপুল অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবে ওই অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। তাই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া কোন প্রকল্পে চীনের কোন ঠিকাদার নিয়োগ হবে, এই প্রক্রিয়া থেকে কে কত কমিশন পাবে—অনেক ক্ষেত্রে সেটাই প্রাধান্য পায় বলে অভিযোগ আছে, যে কারণে ভালো ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। ফলে কাজের মানও ভালো হয় না। অথচ অন্য দেশে যখন চীনা ঠিকাদারেরা কাজ করেন, সেখানে কাজের মান ঠিক থাকে। এর বাইরে বাংলাদেশে প্রকল্প নির্বাচন ও প্রক্রিয়াকরণেও সমস্যা আছে।