বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা

চিঠিতে লেখা রক্তঝরা ১৯৭১

একাত্তরের চিঠি
প্রথমা প্রকাশন

এক যুগ আগে ২০০৯ সালের মার্চে প্রকাশ পায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালের চিঠিপত্রের সংকলন একাত্তরের চিঠি। ওই বছরের ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রকাশনা উৎসব। প্রথম আলো এবং গ্রামীণফোনের এই অসাধারণ উদ্যোগের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ। সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ। মার্চ ২০২১ পর্যন্ত প্রথমা প্রকাশনের এ বইটির ৪৪টি মুদ্রণ প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বিভাগের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বইটির বিক্রি সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ কপি। এই তথ্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জনমানুষের অপার আগ্রহেরই পরিচয়বহ।

বইয়ের ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশে সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে রশীদ হায়দার লিখেছেন, ‘একাত্তরের চিঠির চিঠিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব, বেশির ভাগ চিঠিই লিখেছেন তরুণ যোদ্ধারা; অল্পশিক্ষিত যুবক, স্কুল-কলেজের ছাত্র। লক্ষ করেছি, প্রায় সব চিঠি-লেখক যোদ্ধা যুদ্ধে গেছেন দেশমাতৃকার লাঞ্ছনা ও গ্লানি মোচনের লক্ষ্যে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে। তাঁদের আগে থেকে কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই, প্রশিক্ষণ নেই, এমনকি অনেকে সামান্য গাদাবন্দুক কী, তা–ও জানেন না। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র কতটা মারাত্মক, তা না জেনে যুদ্ধে অংশ নিয়ে যখন বুঝতে পারেন, এ এক অসম যুদ্ধ; তখন, কী বিস্ময়, রণে ভঙ্গ না দিয়ে তাঁরা আরও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি যোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন প্রথামাফিক; অনিয়মিত যোদ্ধারা লড়াই করেছেন প্রাণের আবেগকে শ্রেষ্ঠ অস্ত্র বানিয়ে। এবং এই আবেগের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে প্রকাশিত বেশির ভাগ চিঠিতে।’

সংকলিত চিঠিগুলোর অধিকাংশই লেখা হয়েছে মায়ের উদ্দেশে; দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াইরত যোদ্ধারা মায়ের কাছে মেলে ধরেছেন তাঁদের শ্রেষ্ঠ আবেগ। কিছু চিঠি লেখা হয়েছে বাবাকে, সন্তানকে, আত্মীয়স্বজন কিংবা সহযোদ্ধাকে। দেশের ভেতরে প্রত্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র, বন্দিশালা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মিত্ররাষ্ট্র ভারত থেকে লেখা হয়েছে চিঠি। চিঠি লেখা হয়েছে উত্তাল মার্চ থেকে বিজয়ী ডিসেম্বরে। হয়তো ভুল বানানে কিন্তু মুক্তির পবিত্র প্রত্যয়ে চিঠি পৌঁছে গেছে প্রিয়জনের কাছে।

২৯ মার্চ ১৯৭১ রাজশাহী থেকে কাজী নূরুন্নবী মা নূরুস সাবাহ রোকেয়াকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘মরলে গৌরবের মৃত্যুই হতো। ঘরে শুয়ে শুয়ে মরার মানে হয় কি?’ আমরা জানি, ১ অক্টোবর ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে আটক করে শহীদ জোহা হলে নিয়ে যায়। তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি, হয়তো গৌরবের মৃত্যুই বেছে নিয়েছেন তিনি।

৫ এপ্রিল নৌ কমান্ডো শহীদ জিন্নাত আলী খান মা শুকুরুননেছাকে চিঠিতে যেন বাংলার সমগ্র মুক্তিযোদ্ধা তরুণের মনের কথা লেখেন এভাবে, ‘বিদায় নিচ্ছি মা। ক্ষুদিরামের মতো বিদায় দাও। যাবার বেলায় ছালাম।’

মুক্তির মন্দির সোপানতলে নিজ প্রাণ বলি দিয়েছে কত কিশোরও! চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার কদিন আগে পিতা হাসিমউল্লাহ চৌধুরীকে লেখেন, ‘আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না, কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা। আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহচ্ছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা।’

একাত্তরের চিঠিতে আছে মামা সৈয়দ মোস্তফা কামাল পাশাকে লেখা শহীদ শাফী ইমাম রুমীর চিঠিও; যেখানে প্রকাশিত আসন্ন যুদ্ধকৌশল, ‘ইতিমধ্যে আমাদের যুদ্ধ অনেক এগিয়ে গেছে। বর্ষা শুরু হলে আমরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব।’

বাইখোরা, ত্রিপুরা বেইস ক্যাম্প থেকে সহযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম মুকুলকে লেখা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের চিঠিতে উঠে এসেছে কুমিল্লার বেতিয়ারায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের শাহাদাতের খবর: ‘একটা বিরাট ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। আমাদের প্রিয় আজাদ শহীদ হয়েছে, সাতজন কমরেডের সাথে। অ্যামবুশে পড়ে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করতে করতে তারা শহীদ হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামের কাছে এই যুদ্ধ হয়েছে। আমাদের গেরিলারা ফায়ার করতে করতে ব্যাক করে আসার চেষ্টা করে। ৪০ জনের মতো যোদ্ধা গেরিলা দলে ছিল।’

স্বজন থেকে বহু দূরে যুদ্ধস্থল থেকে কেউ চিঠিতে প্রিয়জনকে ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়েছেন, কেউ রক্তঝরার কালে চিঠি শেষ করেছেন ‘রক্ত-ছালাম’ বলে আর মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব তাঁর মাকে ‘পথের ধারের বাড়ী’ ঠিকানা থেকে ১৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে চিঠিতে লেখেন, ‘মা, পথ চলতে গিয়ে ক্ষণিকের বিশ্রামস্থল রাস্তার ধারের এ বাড়ি থেকে তোমায় চিঠি লিখতে সাহায্য করছে। মাগো, আজ মনে পড়ছে বিদায়বেলায় তোমার হাসিমুখ। শহীদের রক্ত রাঙা পথে তোমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে তুমি এগিয়ে দিয়েছ। ’

বাংলার প্রেরণাদায়ী এমন মায়েদের জন্যই তো বাংলা মা আজ স্বাধীন। ১৯৭১ থেকে ২০২১; শুভ সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশ।

ঘরে বসে বইমেলার বইগুলো পেতে ভিজিট করুন prothoma.com