শুরুটা হয়েছিল গত ২৪ মার্চ। '৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ' শিরোনামে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কার্যক্রমটির শুরু করেছিলেন তরুণ পেশাজীবী ফেরদৌস আহমেদ (উজ্জ্বল)। তবে পবিত্র রমজান শুরুর পর সরাসরি পণ্যসামগ্রী সহায়তা কমিয়ে রাজধানীর নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এক বেলা রান্না করা ডিম-খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে। শুরুতে ৫০ থাকলেও বর্তমানে ২০০ প্যাকেট খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। খাবার নেওয়ার তালিকাটাও দিন দিন বড় হচ্ছে।
ফেরদৌস আহমেদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন (শুভ), সামজির আলম (আরিয়ান), বাবুর্চি সোহেল হোসেনসহ অনেকে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ৪ নম্বরে সাজ্জাদ হোসেনের বাসা। এই স্বেচ্ছাসেবক ডিম আর সবজি খিচুড়ি রান্নার জন্য নিজের বাড়িটাই দিয়ে দিয়েছেন। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খাবার বিতরণের জন্য ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বাক্স, বাজারসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রাখা। সাজ্জাদ হোসেনের মাসহ ভবনের বিভিন্ন তলার নারীরা সবজি কাটা থেকে শুরু করে সবকিছু তৈরি করে দেন। বাসার নিচে সাজ্জাদ হোসেনের বাবার জামিল স্টোর থেকেই আসে বিভিন্ন সদাইপাতি। আর সাজ্জাদ হোসেন যে ভবনে ভাড়া থাকেন, সে ভবনের চারতলায় ভাড়া থাকেন সোহেল হোসেন। করোনাভাইরাস বিস্তারের আগে তিনি রান্না করা খাবার কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন অফিসে দিতেন। বর্তমানে ওই ক্যাটারিং ব্যবসা বন্ধ। তাই তিনিই স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ডিম-খিচুড়ি রান্নার দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর ঘরের সঙ্গে লাগোয়া খালি জায়গাতেই চলে রান্নাবান্না। আর তাতে হাত লাগান সামজির আলমসহ অন্যরা। তারপর প্যাকেট করে বিকেল পাঁচটায় শুরু হয় বিতরণ। এলাকার নিম্ন-নিম্নমধ্যম আয়ের, এমনকি মধ্যবিত্তদের অনেকেই নিয়মিত এ খাবার নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ পরিবেশ আন্দোলনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে আগে থেকেই অংশ নেন। করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ফেসবুকে ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন। সেই ক্যাম্পেইন সময়ের প্রয়োজনে ডালপালা মেলে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।
ফেরদৌস আহমেদ বললেন, 'আমাদের চিন্তাটা ছিল মানুষ বাঁচুক। আমরা প্রায় ৫০০ পরিবারকে চাল, ডাল, আলু, তেল, লবণ, পেঁয়াজ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। প্রত্যেককে ৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, আধা লিটার তেল, আধা কেজি ডাল, পেঁয়াজ, একটি সাবান ও এক প্যাকেট লবণ দিয়েছি। আমাদের সহযোগিতা পেয়েছেন বস্তিবাসী, গৃহকর্মী, রিকশাচালক, হকার, ভাসমান যৌনকর্মী, বেদে সম্পদায়ের মানুষ, পোশাকশিল্পের কর্মী, রাজধানীতে আটকে পড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। কাজ করতে গিয়েই মানুষের একটা করে চাহিদার কথা জানতে পেরেছি বা পারছি। তাই নিম্ন আয়ের পাঁচজন সন্তানসম্ভবা মাকে খাদ্য, ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া শুরু করি। এই মায়েদের সন্তানপ্রসবসহ অন্যান্য খরচের জন্য মানুষের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া টাকার একটি অংশ আলাদা করে রাখছি। কাজ করতে গিয়েই বুঝতে পারি, কিছু মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া জরুরি। প্রথম দিন ৫০ জনের জন্য রান্না করা হলেও খাবার নিতে আসা মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭০। আর বর্তমানে তা ২০০–তে পৌঁছেছে। তালিকাটা বড় হচ্ছে, তাই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে বুঝতে পারছি না।'
গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে সাজ্জাদ হোসেনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কাজ করছেন। কেউ আলু কাটছেন, কেউ কাঁচা মরিচ চিরে রাখছেন। সাজ্জাদ হোসেন, যিনি আলু কাটছেন তিনি তাঁর মা এবং অন্য এক নারীকে দেখিয়ে বললেন, তিনি নিচতলার আন্টি। প্রতিদিনই নিজেদের সংসারের কাজ গোছানোর ফাঁকে ডিম-খিচুড়ি রান্নার কাজে হাত লাগান তাঁরা। সাজ্জাদ হোসেন বললেন, 'যেহেতু আমার বাসায় রান্নার বিভিন্ন প্রস্তুতি চলছে, মা–বাবা, ভাইসহ অন্যরা কাজে হাত লাগাচ্ছেন, তাই কাজের চাপটা কম।'
করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থী সামজির আলমের ভাষায়, 'এটা ভালো কাজ বলে মা নিজেই এ কাজের জন্য পাঠিয়েছেন। রান্নার বিভিন্ন কাজে সহায়তা করি। কাজটা করতে আমার ভালো লাগে।'
বাবুর্চি সোহেল হোসেন ১৭ কেজি চাল, ৪ কেজি ডালসহ রান্নার বিশাল ফিরিস্তি দিলেন। জানালেন, কাজের সুবিধার জন্যই ফেরদৌস আহমেদসহ অন্যরা বড় বড় হাঁড়িপাতিল কিনে দিয়েছেন। কিছু পারিশ্রমিকও দিচ্ছেন। স্ত্রী আর সন্তান গ্রামের বাড়িতে, এখান থেকে নিজের খাবারটাও চলছে।
ফেরদৌস আহমেদ বললেন, 'প্রতিটা দিনই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। অন্তত ঈদ পর্যন্ত ডিম-খিচুড়ি রান্না করা, ঈদের দিন একটু ভালো খাবার দেওয়াসহ অনেক পরিকল্পনা আছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সমাজের কতজন আসলে এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে চাইছেন, তার ওপর। মানুষের সহায়তা ছাড়া এ কার্যক্রম চালু রাখা খুব কঠিন কাজ।'