পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে রেলওয়ের অনলাইন টিকেটিং ও রিজার্ভেশনের কাজ দিতে ‘দুরভিসন্ধিমূলক ও চাতুর্যপূর্ণ’ উপায়ে দরপত্র মূল্যায়ন করার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগটি করেছে সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)।
পাঁচ বছরের জন্য অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য নতুন অপারেটর নিয়োগ দিতে গত বছরের শুরুর দিকে দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের কাজ করার কথা।
গত বছরের মার্চে বর্তমান অপারেটরসহ ৯টি কোম্পানি দরপত্রে অংশ নেয়। নভেম্বরে সহজ লিমিটেড বাংলাদেশ ও সিনেসিস আইটির যৌথ উদ্যোগকে (জেভি) সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচন করে সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। তাদের বিবেচনায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান ছিল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস (সিএনএস)। সিএনএস বেশ কয়েক বছর ধরে টিকেটিংয়ের কাজ করছে।
সহজ-সিনেসিসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরপ্রক্রিয়া শুরু হলে ২০০৮-এর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার ৫৭ ধারা অনুসারে, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিপিটিইউর মূল্যায়ন প্যানেলের কাছে অভিযোগ দায়ের করে বর্তমান অপারেটর সিএনএস। তাদের অভিযোগ, কী কারণে তাদের বাদ দেওয়া হলো, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি।
দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সহজ-সিনেসিসের আর্থিক প্রস্তাব ছিল যাত্রীপ্রতি ২৫ পয়সা, যা প্রাক্কলিত সার্ভিস চার্জ ৪ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে ৯৪ শতাংশ কম। এতে সরকারের প্রাক্কলনের তুলনায় ৮৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
আর সিপিটিইউর মূল্যায়ন প্যানেল শুনানির পর ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত রায়ে বলা হয়, দরপত্র প্রাক্কলনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছিল। বর্তমান দর ২ টাকা ৯৯ পয়সা ভিত্তি ধরে তারা বিগত ছয় বছরের মুদ্রাস্ফীতি ও টিকেটিংয়ের কর্মপরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত সর্বনিম্ন দরদাতার দর দেখে প্রতীয়মান হয়—হয় প্রাক্কলনটি অতিমূল্যায়িত, নতুবা সর্বনিম্ন দরদাতা যোগসাজশ করে দুর্নীতির মানসে এমন প্রস্তাব দিয়েছে।
প্যানেলের রায়ে আরও বলা হয়, বর্তমান দরপত্রে রেল কর্মকর্তাদের অপরিণামদর্শিতা, কর্তব্যকাজে অমনোযোগিতা, সর্বোপরি যোগসাজশে কর্মসম্পাদনের বিষয়টি প্রকটভাবে কাগজে–কলমে দৃশ্যমান। দরপত্র প্রক্রিয়ায় যুক্ত যেসব কর্মকর্তা এই দুরভিসন্ধিমূলক ও চাতুর্যপূর্ণ কার্যক্রম করেছেন, তদন্ত কমিটি গঠন করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে প্যানেল।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম গত ২১ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, সিপিটিইউ শুনানি করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, এখানে কিছু অনিয়ম আছে। এখন নতুন করে দরপত্র আহ্বানের দিকে যেতে হবে।
পাঁচ বছরে মোট ২০ কোটি টিকিট বিক্রির লক্ষ্য সামনে রেখে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি টিকিট মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে বিক্রি হবে। বাকি টিকিট বিক্রি হবে কাউন্টার থেকে। এই কাজের জন্য প্রায় ৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা দর দেয় সহজ-সিনেসিস। আর একই কাজের জন্য সিএনএস দর প্রস্তাব করে প্রায় ৭৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
অনলাইনে কেনার ক্ষেত্রে প্রতি টিকিটের জন্য বাড়তি ২০ টাকা চার্জ নেওয়া হবে গ্রাহকের কাছ থেকে। এর মধ্যে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা বিকাশ, রকেট, নগদ ও বিটিআরসি পাবে। অপারেটর পাবে ৬ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ ৮ কোটি অনলাইন টিকিটের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ বাবদ পাঁচ বছরে ৫২ কোটি টাকা পাবে টিকিট অপারেটর। এই টাকা অপারেটর সরাসরি পেয়ে যাবে; রেলের কাছ থেকে নিতে হবে না। তাই মূল দর থেকে ৫২ কোটি টাকা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয় দরপত্রে।
সহজ-সিনেসিস তার দরপত্রে পাঁচ বছরে টিকিট বিক্রির জন্য সার্ভিস চার্জ হিসেবে রেলওয়ের কাছে প্রায় ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে। সিপিটিইউর রায়ে বলা হয়, এ হিসাবে প্রতি টিকিটে সার্ভিস চার্জ দাঁড়ায় ১ টাকা ৫১ পয়সা।
সহজ-সিনেসিসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরপ্রক্রিয়া শুরু হলে ২০০৮-এর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার ৫৭ ধারা অনুসারে, এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিপিটিইউর মূল্যায়ন প্যানেলের কাছে অভিযোগ দায়ের করে বর্তমান অপারেটর সিএনএস। তাদের অভিযোগ, কী কারণে তাদের বাদ দেওয়া হলো, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি।
তাহলে মূল্যায়ন কমিটি সর্বনিম্ন দর ২৫ পয়সা বলল কীভাবে? সহজ-সিনেসিস তাদের দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাবে বলেছে, ট্রেনের টিকিট এবং রেলের টিকেটিং ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঁচ বছরে তারা ২৫ কোটি টাকা আয় করবে। ওই টাকা তারা নেবে। ফলে পাঁচ বছরে ২০ কোটি টিকিটের জন্য তারা রেল থেকে আর নেবে মাত্র ৫ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি টিকিটের বিপরীতে তাদের দর মাত্র ২৫ পয়সা।
কিন্তু সিপিটিইউ মূল্যায়ন প্যানেল বলছে, সহজ-সিনেসিস রেলওয়ের কাছ থেকে প্রকৃতপক্ষে ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকাই নেবে। কারণ, বিজ্ঞাপন থেকে আসা ২৫ কোটি টাকা রেলের নিজস্ব তহবিল। সহজ-সিনেসিস তা নিতে পারে না।
অন্যদিকে সিএনএস ২০ কোটি টিকিটের জন্য দর দিয়েছে ২৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, প্রতি টিকিটের খরচ পড়ে ১ টাকা ২২ পয়সা। সিপিটিইউ প্যানেলের রায়ে বলা হয়েছে, সহজ-সিনেসিস যোগসাজশের মাধ্যমে আর্থিক প্রস্তাবের ৮ নম্বর মেইন হেডে একটি অতিরিক্ত লাইন যোগ করে বিজ্ঞাপন থেকে প্রায় ২৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় দেখিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের দেওয়া দর থেকে তা বিয়োগ করেছে। অন্য কোনো দরদাতা এমন প্রস্তাব দেননি।
সহজ-সিনেসিস প্রথম আলোয় পাঠানো বক্তব্যে বলেছে, ‘আমাদের বিরুদ্ধে সিপিটিউইয়ে দুটি অভিযোগ তোলা হয়েছে। একটি টিকিট বিক্রির অভিজ্ঞতা নিয়ে, অন্যটি বিজ্ঞাপন ব্যয় নিয়ে। অভিযোগ করা হয়েছে, ‘আমরা বছরে ৫০ লাখ টিকিট বিক্রি করি না। বাস্তবে আমরা প্রায় ১০০টি পরিবহনের কাজ করি ছয় বছর ধরে। এতে বছরে ১ কোটি ৮০ লাখ টিকিট বিক্রি করি, যা রেলওয়ের কাছে নিশ্চিত করা হয়।’
দ্বিতীয় অভিযোগের বিষয়ে সহজের বক্তব্য হলো, তাদের দরপত্রে বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের কথা বলা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যয় কমে। এ প্রক্রিয়ায় টিকিটপ্রতি ২৫ পয়সা দর দেওয়া হয়, যা ছিল সর্বনিম্ন মূল্য। পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে।
তবে সিপিটিইউর রায়ে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, এ ধরনের বিজ্ঞাপন খাতে পাঁচ বছরে আরও কয়েক গুণ বেশি আয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর এ টাকা একান্তভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের তথা সরকারের নিজস্ব আয়। এ বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করার জন্যই পারস্পরিক যোগসাজশে সহজ-সিনেসিস এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বেআইনিভাবে তা অনুমোদন করেছে।