পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল মঙ্গলবার জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম সাক্ষী ইফতেখার হায়দার চৌধুরী (৪৯)। তিনি শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাতিজা।
জবানবন্দিতে ইফতেখার হায়দার বলেছেন, একাত্তরে তাঁর চাচা মোফাজ্জল হায়দারকে যেসব আলবদর ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে মুঈনুদ্দীন ছিলেন। চাচা ওই সময় মুঈনুদ্দীনকে চিনেছিলেন এবং মুঈনুদ্দীন তাঁর কথার জবাবও দিয়েছিলেন।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ ইফতেখারের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান।
জবানবন্দিতে ইফতেখার হায়দার বলেন, শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাঁর বাবার বড় ভাই। চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক পাকিস্তান সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চালালে তিনি এর বিরোধিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ১২ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত চাচা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় থাকতেন। তবে ১২ ডিসেম্বর তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁদের শান্তিবাগের বাসায় আশ্রয় নেন। চাচা কাজের ছেলে নুরুকে ফুলার রোডের বাসায় রেখে যান এবং তিনি কোথায় যাচ্ছেন তা বলে যান।
রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আলবদরের একটি সশস্ত্র দল ফুলার রোডের বাসায় গিয়ে চাচাকে না পেয়ে নুরুকে জিজ্ঞাসা করে চাচার অবস্থান জেনে নেয়। পরে আলবদর সদস্যরা নুরুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের শান্তিবাগের বাসায় এসে দরজার কড়া নাড়ে। তাঁর বাবা লুৎফুল হায়দার চৌধুরী দরজা খুললে মুখোশপরা আলবদররা জানতে চান, মোফাজ্জল হায়দার কোথায়? একপর্যায়ে আলবদররা জোর করে ঘরে ঢুকে পড়লে চাচা এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনিই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। আলবদরদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাঁর বাবা সামনে থাকা এক আলবদর সদস্যের মুখ ঢাকা থাকা রুমাল ধরে টান দেন। এতে মুখ থেকে রুমাল সরে গেলে ওই ব্যক্তির মুখ দেখে চাচা বলেন, ‘তুমি মুঈনুদ্দীন না?’ উত্তরে মুঈনুদ্দীন বলে, ‘জি, আমি মুঈনুদ্দীন, আমি আপনার ছাত্র।’ ওই সময় তিনি (সাক্ষী) বাবা ও চাচার পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন। ওই সময় মুঈনুদ্দীন আরও বলেছিলেন, ‘আমি স্যারকে নিয়ে যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়েই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।’ পরে তাঁর চাচাকে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইফতেখার হায়দার বলেন, তাঁর মেজো চাচা এহতেশাম হায়দার চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে চিনতেন। কারণ, তিনি পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করতেন এবং মুঈনুদ্দীন ছিলেন তাঁর সহকর্মী। দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর তাঁরা বিভিন্ন স্থানে চাচার লাশের খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও লাশ পাওয়া যায়নি।
ইফতেখার হায়দার আরও বলেন, তাঁর মা ডলি চৌধুরীও (মৃত) ছিলেন চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি ওয়ার ক্রাইমস ফাইলের তথ্যচিত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মুঈনুদ্দীনকে দেখার কথা বলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্বদেশ পত্রিকায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ছবি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন ছাপা হলে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তা দেখেন এবং মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পারেন।
ইফতেখার হায়দারের জবানবন্দি শেষ হলে এই মামলার কার্যক্রম আজ বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আলীমের মামলার কার্যক্রম ১৯ আগস্ট: একই ট্রাইব্যুনাল গতকাল বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করেন। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অসুস্থ। এ কারণে তাঁরা মুলতবির আরজি জানান।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের শেষ সাক্ষী ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আসামিপক্ষের জেরা চলছে।