সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি যখন আড়মোড়া ভাঙছেন, ততক্ষণে কিবরিয়া গাজী আড়াই লাখ টাকার মাছ বিক্রি করে ফেলেছেন। পানি আর মাছের মিতালি গড়ে মাত্র কয়েক বছরে নিজের সকালকে এমন সুন্দর করে তুলেছেন কিবরিয়া।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার মুনসেফের চর গ্রামে কিবরিয়ার বাড়ি। শুধু মাছের খামারই নয়, করেছেন মুরগি ও গরুর খামারও। মাছ, মুরগি, গরু—তিনে মিলিয়ে জেলার সবচেয়ে বড় সমন্বিত খামারি এখন ৩৮ বছরের কিবরিয়া।
পদার্থবিদ্যা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) করা কিবরিয়া কখনো চাকরি খোঁজেননি। এখন তিনি চাকরি দিচ্ছেন। কর্মসংস্থান করেছেন শ খানেক লোকের। তাঁর সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছে অন্যদেরও। আশপাশের এলাকার শতাধিক ব্যক্তি এখন মাছের খামার করছেন। গরু ও মুরগির খামারও আছে অনেকের।
চাচার পুকুরে শুরু
১৯৯৬ সালের কথা। কিবরিয়া তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বাড়িতে মাটি কাটায় ঘরের পাশে ছোট একটা গর্ত হয়। শখের বশে তিনি সেই গর্তে ৪০-৪৫টি কার্প মাছের পোনা কিনে এনে ছেড়ে দেন। কিছুদিন পর সেই পোনা বড় হয়। সেগুলো নিয়ে ছাড়েন চাচার পুকুরে। বছর শেষে পুকুর সেচে সেই মাছ বিক্রি করে তাঁর হাতে আড়াই হাজার টাকা তুলে দেন চাচা।
কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনার পর মাছ চাষের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। মাছ বিক্রি করে দেখেন, অনেক টাকা হয়। এরপর তাঁর বাবা পুকুর কেটে দেন তাঁকে।
১টি থেকে ৬৫ পুকুর
১৯৯৮ সালের দিকে নিজের পুকুর হয়। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। তিনিই প্রথম ওই এলাকায় ‘খাবার’ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। সময় গড়িয়ে যায়। ২০১০-১১ সালের দিকে ৪০-৪৫টি পুকুর ইজারা নিয়ে পুরোদমে খামার শুরু করেন তিনি। এখন ৬৫টি পুকুরে মাছের চাষ করেন কিবরিয়া। এর মধ্যে ১২টি পুকুর তাঁর নিজের। ১০টি পুকুরে করেন পোনা উৎপাদন।
কিবরিয়া বলেন, এখন দিনে গড়ে আড়াই লাখ টাকার মাছ বেচেন তিনি। সাধারণত রাত ১০টার পর মাছ ধরা শুরু হয়। মাঝেমধ্যে দিনেও ধরা হয়। সকালে বিভিন্ন আড়তে পাঠিয়ে দেন সেগুলো। বিক্রির পর আড়তদারেরা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন। আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরাও এসে মাছ কিনে নিয়ে যান। তাঁর মাছ বিক্রির আড়তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাজধানীর কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, গাউছিয়া এবং নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামেও যায় তাঁর মাছ।
খামারে এক দিন: পুটিয়া ও আয়ুবপুর—এই দুই ইউনিয়ন মিলে শতাধিক একর জমিতে ছড়িয়ে আছে কিবরিয়ার খামার। প্রধান খামারটি ইটাখোলা এলাকায়। এখানে ঢুকতে গেলে প্রথমেই ঝিরঝিরে পানির ছোট জলাধার পার হতে হয়। কিবরিয়া জানালেন, এই জলাধারের পানিতে জীবাণুনাশক মেশানো। এতে পা ভিজিয়ে ঢুকলে খামারে বাইরের জীবাণু প্রবেশ করবে না।
ঢুকতেই দোতলা মুরগির খামার। মুরগির বিষ্ঠার হালকা কটু গন্ধ নাকে আসার আগেই চোখ যাবে দিঘির জলে। তাতে নানা জাতের মাছ খলবলিয়ে বেড়াচ্ছে। আছে শিং, কই, পাবদা, গুলশা, তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই, কাতলাসহ কার্পজাতীয় নানা প্রজাতির মাছ। দিঘির পাশের জমিতে করা হয়েছে ঘাসের আবাদ। এই ঘাস যায় গরুর খামারে।
কিবরিয়ার খামারের অফিসে ঢুকে বোঝা গেল, পুরো খামার ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে বসেই বিশাল খামার তত্ত্বাবধান করেন কিবরিয়া। তিনি জানান, তাঁর খামারে এখন ৪০ জন স্থায়ী কর্মী আছেন। দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন আরও ৪০ থেকে ৪৫ জন।
কথা হয় মুরগির খামারের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আনিসুর রহমান এবং কর্মী ফারুক হোসেন, ইমন মিয়াসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের কেউ পুকুরে খাবার দিচ্ছেন, কেউ মুরগিকে আধার দেওয়ায় ব্যস্ত, কেউবা গরুর খাবার তৈরি করছেন। তাঁরা জানালেন, খামারে কাজ করেই সংসার চলে তাঁদের।
মুনসেফের চরের খামার থেকে বেরিয়ে কিবরিয়ার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে কোদালিয়া গ্রাম। এখানে যত দূর চোখ যায়, পুকুর আর পুকুর। কোনো পুকুরে খেলা করছে মাছের ঝাঁক। কোনো পুকুর কাটা হচ্ছে এক্সকাভেটর যন্ত্র দিয়ে।
এখানে কতটি পুকুর আছে? সরল হেসে কিবরিয়া বলেন, ‘গুনে বলতে হবে।’ হাতের কড়ে গুনে পাওয়া গেল ১৪টি পুকুর। এত কম বয়সে এত বড় খামার কীভাবে করলেন, জানতে চাইলে কিবরিয়া কিছুটা বিব্রত হন, লাজুক হাসেন। বলেন, ‘কীভাবে যে এত তাড়াতাড়ি সফল হলাম, বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলব, হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কারও কথায় পিছু হটাও চলবে না। কাজ শুরু করে শুধু এগিয়েই যেতে হবে।’
কিবরিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. তোফাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অফিসে তরুণেরা এলে তাঁদের কিবরিয়ার উদাহরণ দেওয়া হয়। অনেকেই তাঁকে সফল হতে দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন। এত অল্প বয়সে, অল্প সময়ে এমন সফল হওয়ার গল্প সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।’
২০১৩ সালের দিকে পাঁচ হাজার মুরগি নিয়ে খামার করা শুরু করেন কিবরিয়া। এখন তাঁর মুরগির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। দিনে ডিম উৎপাদন হয় ১৪ হাজার। তবে এই মুহূর্তে খামারিরা লোকসান দিচ্ছেন বলে জানান কিবরিয়া।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে পাঁচটি গরু নিয়ে খামার শুরু করেন কিবরিয়া। এখন দুটি খামারে তাঁর মাংস উৎপাদনকারী শ খানেক গরু রয়েছে। আছে ২০টি গাভি ও ১২টি বাছুরও।
কিবরিয়া বলেন, তাঁর খামারে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা দামের গরু আছে। মূলত কোরবানির ঈদের সময় গরু বিক্রি করেন তিনি। গত ঈদে তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকার গরু বিক্রি করেছেন। লাভ হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। এখন আগামী কোরবানির জন্য প্রায় ১০০ গরু বড় হচ্ছে খামারে। শিগগিরই দুধ উৎপাদনের জন্য ১৫০-২০০ গাভি যুক্ত করবেন খামারে।
পুরো খামারের বর্জ্য দিয়ে কিবরিয়া তৈরি করেছেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। খামারে সব জ্বালানির জোগান দেয় এই প্ল্যান্ট।
সব মিলে কিবরিয়ার খামারের আর্থিক চিত্রটি কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাভ আর ভালো লাগা আছে বলেই রাতদিনের পরিশ্রমকে পরিশ্রম বলে মনে হয় না।
কিবরিয়াকে দেখে উৎসাহিত হয়ে গরুর খামার করে অন্তত সাত যুবক সফল হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে টিটু শিকদার ও জহিরুল ইসলাম অন্যতম। মাছ চাষ করে সফল হওয়া ব্যক্তিদের অন্যতম শাহ আলম। তাঁরা বলেন, কিবরিয়ার সফলতা তাঁদের এই পথে এনেছে। বিভিন্ন পরামর্শের জন্য যখনই কিবরিয়ার কাছে গিয়েছেন, পরামর্শ, উৎসাহ পেয়েছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তাপস কান্তি দত্ত বলেন, কিবরিয়া একজন ভালো খামারি ও উদ্যোক্তা। জেলায় লেয়ার মুরগি, গরু পালন ও মাছ চাষের সমন্বিত খামারের মধ্যে তাঁরটাই সবচেয়ে বড়। নরসিংদীর তরুণেরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন এই ভেবে যে চাকরির চেষ্টা না করে একজন যুবক কৃষিনির্ভর সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন।