বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, দেশে ভালো সিনেমা আর হয় না, হবেও না—কিছুদিন আগেও অনেকের মুখে এ ধরনের কথা শোনা যেত। করোনা মহামারির কারণে বিধিনিষেধ শুরু হলে আমার নিজেরও মনে হচ্ছিল, এই বুঝি দেশের চলচ্চিত্রের কফিনে শেষ পেরেক লেগে গেল। তবে হাল ছাড়িনি।
নীরবে নিজের স্টুডিওতে নিজের প্রথম সিনেমা নোনাজলের কাব্যর সম্পাদনার কাজ শেষ করেছি। তারপর যখন লন্ডন, বুসান, তুরিন, গুটেনবার্গসহ নানা চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ডাক এল, তখন যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেলাম। মনে হতে লাগল এত দিনের শ্রম বৃথা যায়নি। তবে এ–ও বুঝলাম, দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে অন্ধকার, আমার একার সিনেমা দিয়ে তা দূর হবে না। পথে অনেক অনেক বাধা। ঠিক সে সময়ই আশার আলো হয়ে চলচ্চিত্রের আকাশে নতুন এক নক্ষত্রের উদয় হলো রেহানা মরিয়ম নূর। নতুন বললে ভুল হবে, পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য (লাইভ ফ্রম ঢাকা) ছবি হলে গিয়ে দেখেছি সেই দুই বছর আগে এবং তখনই তাঁর সম্ভাবনা টের পেয়েছি।
কিন্তু কেন যেন এখনো আমাদের দেশে সৃজনশীল ও মৌলিক কাজের আলাদা কদর নেই; কিংবা বিদেশ ঘুরে আসার পর এর কদর দেওয়া হয়। এ দেশে নতুনদের খুঁজে নেওয়া হয় না, নতুনদেরই নিজেদের উপস্থিতির জানান দিতে হয়। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, সারা পৃথিবীতেই কি তাই নয়? হ্যাঁ তা কিছুটা সঠিক, তবে নতুনদের কিন্তু গড়েও নিতে হয়, সমাজের সেই দায়িত্ব রয়েছে, রাষ্ট্রের তো রয়েছেই।
আজ থেকে ১০ বছর পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার সঙ্গে ওপরের আলোচনার সম্পর্ক রয়েছে। রেহানা মরিয়ম নূর ও নোনাজলের কাব্য এই দুটি চলচ্চিত্র কিন্তু হঠাৎ করে ‘আন্তর্জাতিক’ হয়ে ওঠেনি। এই ‘হয়ে ওঠা’র পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক যাত্রাপথ—যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি ‘ডেভেলপমেন্ট, প্রোডাকশন ও পোস্ট–প্রোডাকশন’। রেহানা দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান উৎসবের ডেভেলপমেন্ট অনুদান এবং এর মার্কেটে পিচিংয়ের সুযোগ পেয়েছে শুরুতেই। শুটিংয়ের পর পেয়েছে দোহা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সম্পাদনা–সহায়ক অনুদান। একইভাবে নোনাজলের কাব্য চিত্রনাট্যের জন্য পরিচালক স্পাইক লি থেকে অনুদান পেয়েছে, ফ্রান্সের সিএনসি থেকে পেয়েছে সিনেমা দু মুন্ড অনুদান। চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে ছোট ছোট এই বিজয় যেমন মনোবল বাড়ায়, আবার এতে করে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র প্রযোজক, বিপণন প্রতিনিধি ও পরিবেশকদের চোখেও পড়া যায়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি ঘটে, তা হলো যিনি নির্মাতা, তিনি তাঁর চিত্রনাট্য (কিংবা রাফকাট) বারবার ঝালাই করে নিতে পারেন। অনেকের মতামত শোনার পর শেষ সিদ্ধান্ত কিন্তু সাধারণত নির্মাতার একার। তবে তত দিনে তিনি জেনে যান তাঁর ছবির দৌড় কত দূর, কিংবা এর বাজার কোথায়।
সিনেমা নির্মাণের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। সিনেমার সফলতার সঙ্গে গবেষণা, বাজার, তহবিল ও উৎসব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বের যেসব দেশে সিনেমা একটি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়েছে এবং সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রীতিমতো অবদান রাখছে, সেসব দেশেই কিন্তু এই ইকো-সিস্টেম গড়ে উঠেছে। এগুলোর কাজ নির্মাতাকে গড়ে নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তো রয়েছেই, ইউরোপের বড় দেশগুলোতেও এমন সুযোগ বা ব্যবস্থা দেখা যায়। শুধু পার্থক্য হচ্ছে কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা চালানোর দায়িত্বে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, আবার কোনো দেশে তা চালায় ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। আমার প্রত্যাশা—আগামী ১০ বছরে আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থাগুলো গড়ে উঠবে। কেননা, মাত্র দু–একটি কাজ প্রতিবছর বাইরে যাবে, কিন্তু বাকিগুলোর কী হবে? এ মুহূর্তে দেশে যে দু-একটি বাজার, প্রতিষ্ঠান, উৎসব রয়েছে, সেগুলোর পরিধি খুবই সীমিত এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আয়োজকদের আন্তরিকতায় কোনো ত্রুটি নেই, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে তাঁরা যে অর্থসহায়তা পান, তা খুবই সামান্য। আর ব্যক্তিপর্যায়ের অর্থায়ন তো চলচ্চিত্রে তেমন নেই বললেই চলে।
আরেকটি কথা হলো, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা না হয় তৈরি হলো, কিন্তু সেগুলো আমরা দেখাব কোথায়? দেশের প্রতিটি জেলায় প্রেক্ষাগৃহ হবে শুধু শুনে আসছি, কিন্তু কোনো বাস্তবায়ন দেখছি না। জেলায় জেলায় তো বটেই উপজেলা পর্যায়েও ছবি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। আর এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। এসব হলে বিদেশি সিনেমা চালানো হোক, আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু দেশি সিনেমা যেন গুরুত্ব পায়। তবে কী ধরনের গল্প বলা হবে কিংবা গল্পে কী বলা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ না করাই ভালো। সার্টিফিকেশনের নামে এমন কোনো আইন পাস করা ঠিক হবে না, যার কারণে নির্মাতাদের মুক্তচিন্তার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
চলচ্চিত্রের যে কী ভীষণ শক্তি, তা আমি টের পেয়েছি গঙ্গামতির চরে নোনাজলের কাব্যর প্রদর্শনী করতে গিয়ে। এক হাজার জন জেলে কী মনোযোগ দিয়ে বড় পর্দায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখলেন! সেই আসরে উপস্থিত প্রত্যেক শিশু–কিশোর সেদিন হেসেছে, স্বপ্ন দেখেছে। নীতিনির্ধারক মহলের অতিথিরা নড়েচড়ে বসেছেন। দুই পক্ষের মধে৵ একটি আলোচনা হয়েছে, তাতে জেলেরা তাঁদের অধিকারের কথা বলেছেন। ছবিতে দেখানো বিদ্রোহ উঠে এসেছে বাস্তবে। চলচ্চিত্রের এত শক্তি, একে সমাজ পরিবর্তনে কাজে লাগাতে হবে, কোনোক্রমেই নিঃশেষ হতে দেওয়া যাবে না।
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত, চলচ্চিত্র নির্মাতা