২০১৬ সালে ওমানে দুর্ঘটনার পর আর জ্ঞান ফেরেনি দ্যুতির মায়ের। আর ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আরেক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার বাবা।
২০১৬ সালে ওমানে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন ১২ বছর বয়সী রাজিয়া রাহাত খান লোদীর (দ্যুতি) বাবা–মা। দুর্ঘটনায় আহত বাবা সেবার ফিরে এলেও এরপর আর মায়ের জ্ঞান ফেরেনি। এর মধ্যে কিছুদিন আগে ঢাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আর ফিরতে পারেননি দ্যুতির বাবা। এতে চরম অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে তার জীবনে।
সম্প্রতি রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসায় কথা হয় দ্যুতির সঙ্গে। সে জানায় তার বদলে যাওয়া জীবনের গল্প। দ্যুতির ঘরের পাশেই মা অ্যানির ঘর। যেখানে তিনি নিথর শুয়ে আছেন।
দ্যুতির মা অ্যানি নতুনা দেওয়ান (কথা) ছিলেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। পড়াশোনা শেষে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছেন। পরে চাকরি নিয়ে চলে যান ওমানে। স্বামী-সন্তানসহ থাকতেন দেশটির বন্দরনগরী সালালায়। ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী নূর নেওয়াজ খান লোদী। ওই দুর্ঘটনার পর আর আর জ্ঞান ফেরেনি অ্যানির। দুই সপ্তাহ অজ্ঞান ছিলেন নূর নেওয়াজ খানও। পরে তিনি সুস্থ হন। তবে গত ৪ ডিসেম্বর মেয়ের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে বাসায় ফেরার পথে আগারগাঁওয়ে দ্রুতগতির একটি কাভার্ড ভ্যান চাপা দেয় তাঁকে। এতে তিনি মারা যান।
বাবা নেই, মা থেকেও নেই। এ অবস্থায় তার পাশে দাঁড়িয়েছেন বড় চাচা নূর মোহাম্মদ খান লোদী ও চাচি ইভা নয়না দেওয়ান। আর দ্যুতির একাকিত্বের সঙ্গী হয়েছে দুই বন্ধু অয়ন্তি ও আদিবা এবং সামা ও সাহাব নামের দুটি লাভ বার্ড।
ও লেভেল শেষ করে এ লেভেলের জন্য প্রাইভেট কোচিং করছে দ্যুতি। তার সামনের দিনগুলো চলবে কীভাবে? ওর মাকে কে দেখবে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না চাচা নূর মোহাম্মদ খান লোদী। তিনি বললেন, ‘আমরা একটা ট্রমার মধ্যে ছিলাম। তারপর এমন একটি ঘটনা আবার আমাদের পরিবারেই ঘটবে, তা কখনোই কল্পনাও করিনি। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। আমার স্ত্রী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তা–ও ছেড়ে দিতে হয়েছে।’
দ্যুতি বলল, ‘আমি অন্যদের মতো স্বাভাবিক শৈশব পাচ্ছি না বলে বাবা সময় মন খারাপ করত। তাই আম্মুর দায়িত্ব আমার কাঁধে দিত না। বাবা থাকতে আমি পড়াশোনা করতাম, মার ঘরে গিয়ে মার পাশে বসতাম। আর এখন তো বাবার দায়িত্বগুলোও আমাকে নিতে হবে।’
পরিবারটির এখন ঘোর দুঃসময়। সামনে দিন কীভাবে যাবে, এ নিয়ে চিন্তিত নূর মোহাম্মদ খান লোদী। বললেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবার, আমাদের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। দ্যুতির বাবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজ করত। এখন পরিবার কীভাবে চলবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।’
পরিবারটির এমন দুঃসময়ে দ্যুতির বন্ধু ও তাদের বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষক, অ্যানির পরিচিত জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা এগিয়ে এসেছেন। দ্যুতির আগের স্কুলের শিক্ষক দেবাশীষ দেব অন্যদের সঙ্গে উদ্যোগ নিয়ে দ্যুতির এ লেভেল পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচের দায়িত্ব নিয়েছেন।
নূর মোহাম্মদ খান লোদী জানালেন, দুর্ঘটনার পর দেড় বছর সালালার হাসপাতালে ছিলেন অ্যানি। ভাইয়ের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী সেখানে গিয়ে কথার দেখাশোনা করছিলেন। কিন্তু এ সময় ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায় অ্যানিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হয়। দেশে আনার পর অ্যানির চিকিৎসা বাসাতেই হচ্ছে। অ্যানির চিকিৎসায় মাসে খরচ হয় এক থেকে সোয়া লাখ টাকা। হাসপাতালে নিতে হলে বা অন্য কানো জটিলতা দেখা দিলে মাঝেমধ্যে পাঁচ বা সাত লাখ টাকাও লেগে যায়।
নূর মোহাম্মদ খান ভাইয়ের স্মৃতি ভুলতে পারছেন না। বললেন, ‘আমরা পিঠাপিঠি দুই ভাই। একই ক্লাসে পড়তাম। অনেকেই জানতেন আমরা দুই বন্ধু। আমার স্ত্রীর ছোট বোনকে সে বিয়ে করে। আমরা বন্ধুর মতো বড় হয়েছি, পারিবারিক বন্ধন যাতে আজীবন থাকে, তাই হয়তো বাবা–মা এটা চেয়েছিলেন।’