ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৬ শতাংশ। আগামী বছরের জুনে চালুর পরিকল্পনা। কক্সবাজারের ‘ঝিনুকাকৃতির’ স্টেশনে থাকছে লাগেজ রাখার লকার।
পরিকল্পনা অনুসারে, পর্যটন নগরী কক্সবাজার আগামী বছরই রেল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। তখন চট্টগ্রাম থেকে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে। এর জন্য বিশেষ কোচ কেনা হবে। পর্যটন নগরীর প্রতিনিধিত্ব বোঝাতে সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নির্মাণ হচ্ছে ‘ঝিনুকাকৃতির’ রেলস্টেশন। এটি দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন হতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের রেলস্টেশনটি। পুরো স্টেশনটি গড়ে উঠছে ২৯ একর জমির ওপর। আইকনিক স্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার প্রায় সবই থাকছে স্টেশনটিতে।
স্টেশনটি পড়েছে ঝিলংঝা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায়। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রেলস্টেশনটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে এই রেলপথ চালু হলে পর্যটকেরা চাইলে হোটেল ভাড়া না করেই কক্সবাজার ভ্রমণ করে ফিরে আসতে পারবেন।
স্টেশনটিতে থাকছে লকার বা লাগেজ রাখার স্থান। রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রাখতে পারবেন। এর জন্য অবশ্য ভাড়া দিতে হবে। সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরে যেতে পারবেন।
সম্প্রতি নির্মাণাধীন স্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছয়তলা স্টেশন ভবনের চারতলা পর্যন্ত মূল কাঠামো ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। চারতলার ওপরে চলছে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ। কমবেশি ২০০ প্রকৌশলী ও শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন স্টেশন ভবনটির নির্মাণকাজে।
স্টেশন ভবন ছাড়াও আরও ১৭টি স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করা হবে রেলওয়ের পরিচালনা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে।
শুধু কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণ করতেই ২১৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টেশনটিতে যাত্রী প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পথ। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের বড় জায়গা। স্টেশনটির নির্মাণকাজের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৪৫ শতাংশ।
রেলওয়ের প্রকল্প–সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়।
মূল উদ্দেশ্য—পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা।
তবে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের কাজ আপাতত হচ্ছে না। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন না হলে এই কাজ করা সম্ভব নয় বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। তবে কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
রেলওয়ের প্রকল্পের অগ্রগতি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৬ শতাংশ। আগামী জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ২০২৩ সালের জুনে চালু হতে পারে নতুন এই রেলপথ।
প্রকল্প নেওয়ার সময় ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তা বাড়িয়ে করা হয় ২০১৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালে। তখন প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলামসহ রেলের কর্মকর্তারা আগামী ডিসেম্বরে রেলপথটি চালুর কথা বলে আসছেন। তবে রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, চাইলে আগামী ডিসেম্বরে আংশিক চালু করা যেতে পারে। পুরোটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথটিতে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু স্টেশন। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন।
সব স্টেশনের কাজ চলমান। তার মধ্যে ছয়টি স্টেশনের ছাদ উঠে গেছে। রেলপথ বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাটির কাজ পুরো এলাকায় ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রামুর ইসলামাবাদ স্টেশনের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে ট্রেন যাবে, এটা তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না। এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে নিজেরাই বিস্মিত।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এতটা চওড়া নয়। এই সড়কে সব সময় চাপ থাকে। রেল চালু হলে মানুষের যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে।
কক্সবাজার-চকরিয়া অংশের ৫০ কিলোমিটার এলাকায় মাটির কাজের পাশাপাশি এগিয়ে চলছে রেললাইন বসানোর কাজও।
সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাহ থেকে রামু উপজেলার জোয়ারিয়া নালা এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হয়েছে।
স্টেশন ভবনগুলোর কাজও একই সঙ্গে চলমান রয়েছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত আরও প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে ১৯টি সেতুর সব কটি তৈরি হয়ে গেছে। স্টেশন বিল্ডিংগুলোর নির্মাণকাজ চলমান। ভূমি উন্নয়নকাজও শেষ পর্যায়ে।
প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক (এপিডি) আবুল কালাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই রেলপথের জন্য মানুষের আগ্রহ ব্যাপক। রেলপথ, স্টেশন ও ট্রেনের বিশেষ কোচ—সব মিলিয়ে যাতায়াতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করবে। পর্যটক বাড়বে। করোনা মহামারি, জমি অধিগ্রহণে কিছু জটিলতার কারণে কাজ কিছুটা গতি হারায়। তবে এখন পুরোদমে কাজ চলছে।