চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের এম এ মান্নান উড়ালসড়কের মূল নকশায় র্যাম্প ও লুপ ছিল। কিন্তু তা না করেই উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শেষ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। উড়ালসড়ক চালুর চার বছর পর স্থানীয় লোকজনের দাবির মুখে র্যাম্প করলেও লুপ করা হয়নি। এখন সেই র্যাম্পে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা।
অন্যদিকে মুরাদপুরের আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কেও র্যাম্প থাকার কথা ছিল চারটি। কিন্তু নির্মাণ করা হয়েছে দুটি। অথচ এ দুটি উড়ালসড়কে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছিল ২৭৯ কোটি টাকা। মূল নকশা অনুযায়ী কাজ না করার কারণে নগরবাসী উড়ালসড়কগুলোর পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মূল নকশা অনুসরণ না করে সিডিএ ঠিক করেনি।
গত সোমবার সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বহদ্দারহাটের উড়ালসড়কের র্যাম্পের একটি পিলারে ‘ফাটলের’ খবর ও ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতেই র্যাম্পে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। যদিও গত বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ দল সাংবাদিকদের জানান, পিলারে কোনো ফাটল নেই। যানবাহন চলাচল করতে পারবে। তবে আপাতত ভারী যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এই বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিডিএ গত ১০ বছরে ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরে তিনটি উড়ালসড়ক ও একটি ওভারপাস নির্মাণ করেছে। এখন ৩ হাজার ২১২ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে।
ব্যয় বাড়লেও হয়নি র্যাম্প-লুপ
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের যানজট নিরসনে উড়ালসড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিডিএ। নিজস্ব অর্থায়নে করা এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সময়টা ২০১০ সালের জানুয়ারি।
নকশায় মূল উড়ালসড়কের সঙ্গে নগরের কালুরঘাটমুখী একটি র্যাম্প এবং কালুরঘাট থেকে মুরাদপুরমুখী একটি লুপ (উড়ালসড়ক থেকে বাঁক নিয়ে অন্য রাস্তায় সংযুক্ত করা) ছিল। তবে নির্মাণকাজ চলাকালে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর গার্ডার ধসে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। এরপর র্যাম্প ও লুপ নির্মাণ থেকে সরে আসে সিডিএ। পরে শুধু মূল উড়ালসড়ক করে ২০১৩ সালের অক্টোবরে তা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
তবে যানজট নিরসনে এই উড়ালসড়ক কার্যকর না হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কালুরঘাটমুখী একটি র্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। নির্মাণকাজ শেষে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মূল উড়ালসড়ক নির্মাণে ১৪৪ কোটি টাকা এবং র্যাম্প নির্মাণে ব্যয় হয় ১৫ কোটি টাকা। অথচ অনুমোদনের সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ৭০ কোটি টাকা।
এদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়ক খুলে দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ১৬ জুন। এর আগে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘নকশা পর্যালোচনা কমিটি’ গঠন করে সিডিও। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তৎকালীন উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি মূল নকশার সঙ্গে চারটি র্যাম্প নির্মাণের বিষয়টি যুক্ত করে দেয়।
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সিডিএ নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় এবং স্যানমার ওশান সিটির সামনে দুটি র্যাম্প নির্মাণ করে। কিন্তু জিইসি মোড়ের হোটেল পেনিনসুলা এলাকায় বাকি দুটি র্যাম্প নির্মাণ করেনি। আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬৬ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত ব্যয় হয় ৬৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ২০৯ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালকদের ‘অজুহাত’
নগরের বহদ্দারহাট এম এ মান্নান উড়ালসড়কের মূল অংশের কাজে সিডিএর দুই প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এ এম হাবিবুর রহমান। গার্ডার ধসে হতাহতের ঘটনার পর তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইলিয়াছকে।
উড়ালসড়ক থেকে র্যাম্প-লুপ বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রথম আলোকে বলেন, মূল নকশায় র্যাম্প ও লুপ ছিল। কিন্তু মাঝখানে কী কারণে তা বাদ দেওয়া হয়েছিল, তা তাঁর জানা নেই। কেননা তাঁকে গার্ডার ধসের পর মূল উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
প্রথম প্রকল্প পরিচালক এ এ এম হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল নকশায় র্যাম্প-লুপ থাকলেও তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের সিদ্ধান্তে তা বাদ দেওয়া হয়েছিল। চেয়ারম্যান আগে মূল উড়ালসড়ক শেষ করার নির্দেশনা দেন।
এ ব্যাপারে তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণে র্যাম্প ও লুপ বাদ দেওয়া হয়েছে।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কে দুটি র্যাম্প না করার প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কারণে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা থাকায় জিইসি মোড় এলাকায় দুটি র্যাম্প নির্মাণ করা হয়নি। জায়গা পাওয়া গেলে র্যাম্প নির্মাণে কোনো বাধা ছিল না।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
চট্টগ্রাম নগরের উড়ালসড়কগুলোর নির্মাণ, নকশা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকে সোচ্চার ছিলেন। এসব উড়ালসড়ক সর্বোচ্চ কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের পরামর্শ কিংবা মতামত সিডিএ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মাহমুদ ওমর ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কের কোথায় কোথায় র্যাম্প লাগবে, তা বিশেষজ্ঞ কমিটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মানা হলে উড়ালসড়ক অনেক বেশি কার্যকর হতো।
বহদ্দারহাটের এম এ মান্নান উড়ালসড়ক প্রসঙ্গে মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, এই উড়ালসড়কের মূল নকশায় র্যাম্প-লুপ ছিল। কিন্তু সিডিএ মূল উড়ালসড়ক নির্মাণের সময় তা বাদ দিয়েছিল। এটি ঠিক করেনি। পরে লুপ ছাড়া হালকা যানের জন্য করা এই র্যাম্পে ভারী গাড়িও চলাচল করেছে। ফলে ওভারলোডের কারণে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর লুপ না করায় এই উড়ালসড়ক অর্ধেক অকার্যকর হয়ে গেছে।