সিটি নির্বাচন

চট্টগ্রামে ছয় কাউন্সিলর প্রার্থী খুনের আসামি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৪০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭১ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর মধ্যেই ৫৯ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছয়জন হলেন খুনের মামলার আসামি। বাকিরা অস্ত্র, চাঁদাবাজি, হত্যার চেষ্টা, মারামারি ও পাহাড় কাটা মামলার আসামি। ১০ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে চেক প্রতারণার মামলা।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এবং পুলিশ সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। খুনের মামলার আসামিদের মধ্যে পাঁচজন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ও একজন বিএনপির।

২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ হবে। ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে একটিতে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

বাকি ৪০টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ড (দক্ষিণ পাহাড়তলী) কাউন্সিলর প্রার্থী তৌফিক আহমেদ চৌধুরী অস্ত্র ও খুনের মামলার আসামি। তিনি ২০১৬ সালের ৫ মে হাটহাজারীর মির্জাপুরের যুবলীগ কর্মী নুরে এলাহীকে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এ ছাড়া কোতোয়ালি থানায় একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। নগর যুবলীগের সদস্য তৌফিক দলীয় থেকে সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।

৭ নম্বর ওয়ার্ডে (পশ্চিম ষোলোশহর) আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মোবারক আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে এক স্কুলছাত্র হত্যা মামলা। খুন হওয়া দশম শ্রেণির ছাত্র জয়নাল আবেদীনের মা জোহরা বেগম গত বছরের ৭ অক্টোবর এ মামলা করেন। এর আগে ১১টি মামলা থেকে খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছেন এই মোবারক।

১৪ নম্বর ওয়ার্ডে (লালখান বাজার) আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হলেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবুল হাসনাত (বেলাল)। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কলেজছাত্র দিদার হত্যা মামলার আসামি তিনি। পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম বাদ দিলেও নারাজি দেন মামলার বাদী ও নিহতের বাবা নুরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেলালের নির্দেশে আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। তার বিচার যেন হয়।’

এ ছাড়া সনেট চক্রবর্তী নামের এক ব্যবসায়ীকে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আবুল হাসনাত। তবে তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়রানি করতে মামলাগুলো করেছে।

২৮ নম্বর ওয়ার্ড (পাঠানটুলী) থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ২৯টি মামলা ছিল। এগুলোর মধ্যে ২৩টি মামলায় সাক্ষীরা মুখ না খোলায় খালাস পান তিনি।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলায় কারাগারে যান ১২ নম্বর ওয়ার্ডের (সরাইপাড়া) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহম্মদ। বর্তমানে তিনি এই মামলায় জামিনে আছেন। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পাহাড়তলী বাজারে মহিউদ্দিনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

২৮ নম্বর ওয়ার্ড (পাঠানটুলী) থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ২৯টি মামলা ছিল। এগুলোর মধ্যে ২৩টি মামলায় সাক্ষীরা মুখ না খোলায় খালাস পান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চার খুনের মামলা থেকে অব্যাহতি পান কাদের। সর্বশেষ নির্বাচনী সহিংসতায় ১২ জানুয়ারি আজগর আলী হত্যা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এ ছাড়া অপহরণ মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি তিনি।

এসব প্রার্থীর মধ্যে তৌফিক, মোবারক ও আবুল হাসনাত নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সাবের ও কাদের পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে। এই দুই নেতার বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।

খুনের মামলার আসামিদের দলের কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি করলে মামলা থাকতে পারে। তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া আলাদা বিষয়। খুনের মামলার আসামি প্রার্থী হলে দল স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। ভবিষ্যতে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত।

অন্যদিকে লালখান বাজার ওয়ার্ডে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী শাহ আলম এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা কায়সার হোসেন হত্যা মামলার আসামি। বর্তমানে মামলাটির সাক্ষ্য চলছে। তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলাও রয়েছে।

নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেম দাবি করেন, শাহ আলমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।

চাঁদাবাজি, মারামারি ও পাহাড় কাটা

লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সদস্য ও বিদ্রোহী প্রার্থী এ এফ কবির মানিকের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি ও পাহাড় কাটার মামলা। এ ছাড়া এক লন্ডনপ্রবাসীর বাড়ি দখল এবং জাল দলিল তৈরি করে সরকারি ভূমি আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের (উত্তর পাহাড়তলী) বিদায়ী কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহুরুল আলম ওরফে জসিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ। পাহাড় কাটার অভিযোগে করা একটি মামলার আসামি তিনি। জসিম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।

৪ নম্বর ওয়ার্ডের (চান্দগাঁও) কাউন্সিলর প্রার্থী এসরারুল হকের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে একটি। গত বছরের ৫ এপ্রিল চান্দগাঁওয়ের ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে আমজাদ হোসেন নামের একজনের পা ছিদ্র করে দেন এসরারুলের অনুসারীরা।

বিএনপির সব প্রার্থীই নাশকতার মামলার আসামি

৪০টি ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে ২৩২টি মামলা হয়েছে। নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেমের দাবি, সব কটিই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মামলা।

৪০টি ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবার বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে ২৩২টি মামলা হয়েছে। নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেমের দাবি, সব কটিই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মামলা।

এর মধ্যে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের প্রার্থী আবদুস সাত্তার ওরফে সেলিম ১৮টি মামলার আসামি। ১৫টি করে মামলা রয়েছে গোসাইলডাঙার মো. হারুন ও দক্ষিণ হালিশহরে সরফরাজ কাদেরের নামে। পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর আলমের নামে ১৩টি এবং চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম ও দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের হানিফ সওদাগরের বিরুদ্ধে ৮টি করে মামলা হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনকে খুন, অস্ত্রের মামলাসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অভিযুক্ত প্রার্থীদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।