বসার ঘরের দেয়ালে টাঙানো কাস্টমস কর্মচারী রিপেন সিংহের ছবি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের আসকার দীঘির পশ্চিম পাড়ের বাসায় গিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন বাবা ক্ষুদিরাম সিংহ। অবসরপ্রাপ্ত এই কাস্টম কর্মচারী ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বাবা, তোর তো কোনো শত্রু ছিল না। তোকে কে মারল, এত দিনেও জানতে পারলাম না।’
স্বামীর কান্নার শব্দ শুনে পাশের কক্ষ থেকে ছুটে আসেন প্রতিমা সিংহ। কান্না থামিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে রিপেন ছিলেন ছোট, সবার আদরের। তদন্ত যেভাবে চলছে, বিচার দূরে থাক, ছেলের খুনিদের দেখে যেতে পারেন কি না, সন্দিহান তিনি।
কাস্টমস কর্মী রিপেন সিংহের লাশ উদ্ধারের মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি এখন অবধি। ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর নগরের আসকার দীঘির পাড়ের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন রিপেন সিংহ। রাতে পতেঙ্গার চরপাড়া বেড়িবাঁধ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমেদ সোহেল হত্যা মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রটি গ্রহণের শুনানি আটকে আছে পাঁচ মাস ধরে। গতকাল নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার শেরশাহ কলোনিতে নাসিম আহমেদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেল দুই বোন ফারহানা আক্তার ও রায়হানা আক্তার এবং বড় ভাবি মাহমুদা খাতুনকে। মাহমুদা খাতুন বলেন, নাসিমের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার শ্বশুর-শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন চিকিৎসার জন্য তাঁরা কয়েক দিন আগে ঢাকায় গেছেন। নাসিমের দুই বোনও জানালেন, ভাই হারানোর শোক তাঁরা ভুলতে পারছেন না। বিচারটা যাতে তাঁরা দেখে যেতে পারেন, এটাই ইচ্ছা।
এক বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের সামনে স্কুলছাত্র জাকির হোসেন ওরফে সানিকে ছুরিকাঘাতে খুন করে কয়েকজন কিশোর। ওই মামলায় মার্চের পর গত ছয় মাসে নতুন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। তবে নিহত স্কুলছাত্রের পরিবারের দাবি, তদন্ত থেমে আছে।
দেশব্যাপী আলোচিত চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন জব্দের দুই মামলার বিচারেও নেই অগ্রগতি। শুধু এই চার মামলা নয়, চট্টগ্রামের আলোচিত শতাধিক মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ থেমে আছে। গত পাঁচ মাসে এসব মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন বাদী ও নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, করোনার কারণে কাজ এগোয়নি।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়া উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আলোচিত মামলাগুলোর বিচার ও তদন্তকাজ থেমে থাকলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। এতে অপরাধ বাড়বে।
বিচারাধীন মামলা
করোনাঝুঁকি এড়াতে গত ১০ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ভার্চ্যুয়াল আদালতের মাধ্যমে গত পাঁচ মাসে কোনো মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক হয়নি। শুধু জামিন শুনানি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আদালতের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। সব মামলার শুনানির জন্য তারিখ পড়ছে।
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ৭৪টি আদালতে ২ লাখ ১৮ হাজার ১৯৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে আলোচিত মামলার সংখ্যা ৫০টির বেশি। নতুন ঘটনা যোগ হওয়ায় পুরোনো মামলাগুলো আলোচনার বাইরে চলে যায়।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম হত্যা মামলার বাদী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, এপ্রিলে ১৮ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রটি গ্রহণের শুনানির তারিখ থাকলেও করোনার কারণে হয়নি। ছেলে হত্যার বিচারটি দেখে যেতে চান এই বাবা। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে বিরোধের জেরে নাসিম খুন হন।
চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন জব্দের ঘটনার দুই মামলার মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য চলছে। কিন্তু দিন ধার্য থাকলেও গত পাঁচ মাসে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। চোরাচালান আইনের মামলায় দুই মাস আগে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও এখনো গ্রহণের শুনানি হয়নি। ২০১৫ সালের ৬ জুন পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোকেন সন্দেহে চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের চালান জব্দ করা হয়।
২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির ভেতরে দুটি মসজিদে বোমা হামলায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তাসহ ২৪ জন মুসল্লি আহত হন। সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়নি। একই অবস্থা চলছে ২০১৭ সালে সীতাকুণ্ডে ও মিরসরাইয়ে তিন জঙ্গি আস্তানা থেকে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় করা চার মামলারও।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে করা মামলা চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মনোরঞ্জন দাশ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল।