এই দলে ‘মেসি’ আছে। মেসির দুই বন্ধুও আছে। ময়মনসিংহ থেকে আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেসে তিনজন দুজনের আসনে বসেছে। বিষয়টি এমন নয় যে আসন ছিল না। কিন্তু এই দলের ‘মেসি’ তহুরা তার দুই বন্ধু সাবিনা ও শামসুন্নাহারের সঙ্গেই বসবে। দলের অন্য খেলোয়াড়েরা ঢাকার লা ভিঞ্চি হোটেলে বসে গত বৃহস্পতিবার রাতে যখন এই তথ্য দিল, তখন মেসি হেসেই শেষ।
প্রথম আলোর ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের ১৯ জন মেয়ে ফুটবলার বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসে। তারা সবাই ময়মনসিংহ জেলা মহিলা ফুটবল দলের সদস্য। তাদের ১০ জনই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবল দলে খেলেছে।
সানজিদা আক্তার, মার্জিয়া আক্তার, মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, তাসলিমা আক্তার, কল্পনা আক্তার, ময়না মানকিন, মাহমুদা আক্তার, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সাবিনা আক্তার, সাজেদা আক্তার, সেলিনা খাতুন, সালমা খাতুন, পূর্ণিমা, রুপা, হালিমা খাতুন, ইয়াসমিন আক্তার ও নাজমা আক্তার—এই ১৯ জনের ঢাকায় এটাই প্রথম আসা নয়। তবে খেলা ছাড়া কোনো দিন ঢাকা আসা হয়নি তাদের। প্রথম আলো এই অদম্য মেয়ে ফুটবলারদের বিশেষভাবে সম্মান জানাতে ঢাকায় নিয়ে আসে। সারা দিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সন্ধ্যার পর যোগ দেয় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে প্রথম আলোর ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। এবারের প্রথম আলোর অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় এই অদম্য মেয়েদের।
কথায় কথায় জানা গেল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া তহুরা শুধু ময়মনসিংহ নয়, ঢাকার মাঠেও ‘ছোটদের মেসি’ হিসেবে পরিচিত। প্রথম আলোর অনুষ্ঠান নিয়েও তাদের নানা জল্পনাকল্পনা। কারা আসবে, কী হবে। সন্ধ্যার পরপরই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সারা দিনের ঘোরাঘুরির ক্লান্তি ঘুচে গেল এক নিমেষেই। তাদের নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র দেখে বেশ ভালো লেগেছে তহুরার। সেখানে ছবি তুলেছে নায়ক ফেরদৌস, অভিনেত্রী জয়া আহসান আর বিদ্যা সিনহা মিমের সঙ্গে। উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে ও বলল, ‘এত নামীদামি মানুষের সামনে দাঁড়িয়েছি। আমাদের সম্মানিত করা হলো, খুব ভালো লাগছে।’
এই দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য হলো সালমা। একটু পরপর তার মন খারাপ হয়ে যায়। ঢাকা শহর তার খুব একটা ভালো লাগে না—কারণ যানজট, গাড়ির শব্দ। কলসিন্দুর গ্রামই ভালো। তবে প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে এসে তারও খুব ভালো লেগেছে। চারদিকে জমকালো আলো আর তাদের নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হওয়ায় মন ভালো হয়ে গেছে তার।
ময়মনসিংহ জেলা মহিলা দলের অধিনায়ক মার্জিয়া। খুব লাজুক স্বভাবের। ওদের নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র সম্পর্কে বলল, ‘শুটিং করা কষ্টের। ভিডিও দেখা আনন্দের।’ কাছ থেকে নায়ক-নায়িকা দেখে ওরও বেশ আনন্দ লেগেছে।
মঞ্চ থেকে নেমেই প্রিয় অভিনেত্রী মিমের সঙ্গে ছবি তুলেছে সাবিনা আক্তার। কাছ থেকে এত নায়ক-নায়িকা দেখে খুব আনন্দ লাগছে ওর। সাবিনা বলল, ‘মিমকে খুব ভালো লাগে। ছবি তুলেছি। মজা করেছি।’
অন্য সবাই নায়ক-নায়িকাদের কথা বললেও মারিয়ার ভালো লেগেছে অনুষ্ঠানের মঞ্চ। সে বলে, ‘এত বড় মঞ্চে দাঁড়াইছি। সবাই আমাদের সম্মান জানাইছে। আমাদের নিয়া সবাই মাতামাতি করছে। খুব আনন্দ হইছে।’
বয়সভিত্তিক ফুটবলে সানজিদা এশিয়ার সেরাদের একজন। বলল, ‘২০১১ সালে প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম। রাস্তা পার হতে খুব ভয় লাগত। এখন লাগে না।’
গ্রামের সহজ-সরল এই মেয়েরা মাঠে কতটা অপ্রতিরোধ্য, তা ইতিমধ্যে টের পেয়েছে অনেক দল। গত এপ্রিলে নেপালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দলে ছিল কলসিন্দুরের ১০ কন্যা। গ্রুপ পর্বে তারা ভারতের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। আর ভুটানকে হারায় ১৬-০ গোলে। শক্তিশালী ইরানকে হারায় ২-০ গোলে।
এই দলের সঙ্গে এসেছেন সবার প্রিয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল, সহকারী শিক্ষক ও মেয়েদের কোচ মফিজ উদ্দিন। সঙ্গে আছেন কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মুহম্মদ জালাল উদ্দিন ও সহকারী কোচ সুরঞ্জিত রায়।
মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘পুরো অনুষ্ঠান আমাদের মেয়েদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। আবার ডকুমেন্টারি দেখানো হলো। কত ভালো লেগেছে, এটা বলে বুঝাতে পারব না।’
মিনতি রানী নিজে ফুটবল খেলা ভালোবাসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর চলে যান কলসিন্দুর গ্রামে। তিনি চান, সবার পরিশ্রম যেন সার্থক হয়। এই মেয়েরা একসময় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম ছড়িয়ে পড়বে।
গতকাল শুক্রবার ভোরে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ফুটবলারদের ছবি তুলতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে তারা যাওয়া-আসার পথে দেখেছে সংসদ ভবন। কিন্তু এবারই প্রথম এত কাছ থেকে দেখা। আর সন্ধ্যায় যোগ দেয় সোনারগাঁওয়ের পাঁচতারা হোটেলে প্রথম আলোর ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেখানে হুড়োহুড়ি, আড্ডা আর ছবি তুলেছে বিস্তর। অনুষ্ঠান শেষে যখন ওরা হোটেলে ফিরল, তখন সবার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস আর বাড়ি ফেরার তাড়া। আজ শনিবার সকাল সাতটার ট্রেনে ফিরে যাবে কলসিন্দুরে।
এই মেয়েদের অধিকাংশের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। নিয়মিত আন্তর্জাতিক খেলাও দেখতে পারে না ওরা। চায় মেসি, রোনালদো, নেইমারদের খেলা দেখতে। ছোটদের মেসি যেন বড়দের মেসি হয়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুন: