করোনার আঘাত

ঘরবন্দী দশায় বাড়ছে মনের সমস্যা আর পেটের ক্ষুধা

রাজধানীর শাহবাগ এলাকা।
রাজধানীর শাহবাগ এলাকা।

কোভিড-১৯ রোগের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাল দিতে রাষ্ট্রগুলো যত ব্যবস্থা নিচ্ছে, মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার বিষয়টি ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যখন সুস্থ-সমর্থ সব মানুষের সহায়তা লাগবে, তখন এই অবহেলার দাম দিতে হবে।

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন লকডাউনে বা ঘরবন্দী। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ বলছে, এই মানুষদের গুরুতর মানসিক সমস্যা হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির এ দিকটি করোনাসৃষ্ট অর্থনীতির বিপদকে আরও বাড়াবে।

বাংলাদেশের কয়েকজন মনোবিদ আর অর্থনীতিবিদের কথায়ও এই সমস্যার আলামত পাওয়া গেল। দেশে তিন সপ্তাহ হলো লকডাউন বা ঘরবন্দী অবস্থা চলছে।

বেলজিয়ামের মনোবিদ এলকে ভ্যান হুফ ওই নিবন্ধে ঘরবন্দী মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্বে লকডাউনে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৬০ কোটি। ঘরবন্দী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।

ভ্যান হুফ এ অবস্থাকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, গৃহবন্দী মানুষেরা নানা রকম মানসিক চাপ ও অসুস্থতার শিকার হয়ে থাকে।

এর মধ্যে আছে মন খারাপ, অনিদ্রা, উদ্বেগ-উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বিভ্রান্তি, বিষণ্নতা, রাগ, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ আর বিপর্যয় বা ট্রমা-পরবর্তী মানসিক চাপের নানা লক্ষণ। এলকে লিখছেন, চীনে লকডাউন-সম্পর্কিত প্রাথমিক গবেষণাপত্রগুলোতে তেমন সমস্যার চিত্র উঠে আসছে।

ল্যানসেট–এর নিবন্ধটি বিভিন্ন কোয়ারেন্টিনকালীন ২৪টি গবেষণাপত্রের পর্যালোচনা। এগুলোর মধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর একটি গবেষণার কথা আছে। তাতে দেখা যায়, সঙ্গনিরোধের তিন বছর পরও প্রায় ১০ শতাংশ কর্মীর উচ্চ বিষণ্নতার লক্ষণ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা তৈরি করছে।

এদিকে উহানের হাসপাতালে আসা রোগীদের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত গবেষণার একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ৩৪ শতাংশের বেশি রোগীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ২৮ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা গিয়েছে।

উহানের কেন্দ্রীয় বিবাহ নিবন্ধন বিভাগের হিসাবে প্রদেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদের হার ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন নিয়ে নাগরিকেরা আসছেন।

ভ্যান হুফ বলছেন, কোভিড-১৯ রোগের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাল দিতে রাষ্ট্রগুলো যত ব্যবস্থা নিচ্ছে, মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার বিষয়টি ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যখন সুস্থ-সমর্থ সব মানুষের সহায়তা লাগবে, তখন এই অবহেলার দাম দিতে হবে।

বাংলাদেশে ঘরবন্দিত্বের কুফল
বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় অনেকেই নিজেদের ভয়, আতঙ্ক, উদ্বাগ, হতাশা আর বিষণ্নতার কথা লিখছেন। একজন যেমন লিখেছেন, ‘আর কয়দিন বাসায় থাকলে পাগল হয়ে যাব।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘ডাই অর ডাই’ অর্থাৎ মৃত্যু অথবা মৃত্যু।

ঢাকার অনেক মনোবিদ এখন টেলিফোনে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। একজন মনোবিদকে এক রোগী লিখেছেন, ‘নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাতে দুই–তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম আসছে না। সব সময় মৃত্যু ভয় কাজ করছে।’

আরেকজন লিখেছেন, ‘টেলিভিশন না খুললে, পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। আবার টিভি সংবাদে করোনায় মৃত্যুর সংবাদগুলো দেখে মনে অশান্তি, ভয় ও আতঙ্ক বাড়ছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন তিনি বিষণ্নতা ও মাদকাসক্ত রোগী বেশি পেতেন। এখন অস্থিরতা, অনিদ্রা ও মৃত্যুভয়ের মতো নানা সমস্যার রোগী পাচ্ছেন।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মোশতাক হোসেন জানান, ঐতিহাসিকভাবেই মহামারির সময় মানুষের মানসিক সমস্যা বেড়ে যায়। বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা ছাড়াও তখন অমানবিক ও অযৌক্তিক আচরণ বেড়ে যায়।

প্রথম আলোকে মোশতাক বলেন, এখন যেমন করোনার লক্ষণযুক্ত কারও রক্তের নমুনা সংগ্রহ করতে গেলে স্থানীয় মানুষজন বাধা দিচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে তো বটেই, তার পরিবারের সদস্যদের সমাজ একঘরে করছে। আইইডিসিআরের এই পরামর্শকের মতে, মানসিক সমস্যা থেকেই মানুষ এমন করে। আর ডা. হেলাল জোর দিচ্ছেন পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ানোর ওপর।

ক্ষুধার মানচিত্রে ভেঙে পড়া মানুষ
আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের হিসাব বলছে, করোনাভাইরাসের বিস্তার এবং লকডাউনের কারণে বিশ্বের ৪৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের আয় দৈনিক দুই ডলারের নিচে নেমে যেতে পারে। অর্থাৎ তারা নতুন করে দরিদ্র হবে।

এটা সবচেয়ে বেশি হবে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে। তারপরই ঝুঁকিতে রয়েছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২ কোটি ৮৮ লাখ।

বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রভাবে দেশে কমপক্ষে ৪২ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় দারিদ্র্য বাড়ার একটি ধারাবাহিকতা আছে। বাংলাদেশের মোট চার কোটি মানুষ নিয়মিত বেতন পায়। তাদের কিছুটা সঞ্চয় আছে। বাকি আট কোটি মানুষ এই পরিস্থিতিতে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

শামসুল আলম বলছিলেন, করোনাকালে মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বদল আসছে। মানসিক চাপের প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো সমস্যা বাড়ছে। প্রভাবগুলো দীর্ঘমেয়াদি হবে। সরকারকে দরিদ্রজনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষাও দিতে হবে।

বেলজিয়ামের মনোবিদ এলকে ভ্যান হুফের নিবন্ধটির নাম, ‘লকডাউন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা: এর দাম আমাদের দিতে হবে।’ তিনি আরও লিখছেন, বছরের শেষ ভাগে মনোবল ক্ষয় আর অবসাদের কারণে কাজে মানুষের অনুপস্থিতি বাড়বে। এমন প্রবণতা লকডাউন হওয়া দেশগুলোতে এখনই দেখা যাচ্ছে।

মানুষ অফিসে যেতে ভয় পাচ্ছে। তিন থেকে ছয় মাসের মাথায় এই অনীহা আবারও ফিরে আসতে পারে। ভ্যান হুফ লিখছেন, ইবোলা, সার্স বা মার্সের মতো মহামারি এলাকাগুলোয় এমনকি চিকিৎসা সেবাদানকারীদেরও কাজে অনুপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

বেলজিয়ামের এই মনোবিদ মনে করেন, মানসিক সংকট মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নিলে কোভিড-১৯ লকডাউনের বিষাক্ত ফলাফল কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাঁর পরামর্শগুলো হচ্ছে, মানুষের জন্য আত্মসহায়তার উপায় তৈরি করা; আগ্রহীজনদের মানসিক বিপর্যয়ের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানানোর ব্যবস্থা রাখা; এসব বিষয়ে তথ্য-পরামর্শ আদান–প্রদানের জন্য আলাদা একটি ওয়েবসাইট খোলা; মানসিকভাবে সবচেয়ে বিপন্ন ব্যক্তিরা যেন সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আর বাংলাদেশে ডা. হেলাল ও ডা. মোশতাক বলছেন, সরকারের উচিত করোনার চিকিৎসাসেবায় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা। এ দেশে সেটাই হবে প্রথম করণীয়।