ঢাকার ধামরাইয়ের তেঁতুলিয়া গ্রামের ভূমিহীন আবু সাঈদ আগে বালুঘাটে কাজ করতেন। তখন তিনি থাকতেন স্ত্রী জহুরা বেগমসহ সন্তানদের নিয়ে একটি ভাড়া ঘরে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে। ছেলে বালুর জাহাজে কাজ করেন। আবু সাঈদ এখন উপজেলার বিজয়নগরে একটি বাসায় দারোয়ানের কাজ করেন। সেখানেই স্ত্রীকে নিয়ে একটি কক্ষে থাকেন তিনি।
তবে এবার তাঁদের নিজের ঘর না থাকার দুঃখ ঘুচতে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে উপজেলার সোমভাগ ইউনিয়নের দেপাশাই এলাকায় তাঁদের জন্য আধা পাকা ঘর তৈরি হচ্ছে। দুটি কক্ষ ছাড়াও সেই ঘরের সামনে থাকছে বারান্দা, পেছনে রান্নাঘর, টয়লেট, ছোট আরেকটি জায়গা। ঘরের ২ শতাংশ জমিও তাঁদের নামে লিখে দেওয়া হয়েছে (বন্দোবস্ত)।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে দেশে দুই ধরনের মানুষকে ঘর করে দেবে সরকার। প্রথমত, যাঁরা ভূমিহীন ও গৃহহীন। আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁদের ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত জমি আছে, কিন্তু ঘর নেই কিংবা থাকলেও একেবারে জরাজীর্ণ। গত বছরের জুন পর্যন্ত এই দুই ধরনের মানুষের তালিকাও করা হয়েছে।
আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অসহায় মানুষ, সরকার থেকে ঘর দিচ্ছে। এ জন্য খুব ভালো লাগছে, খুশি লাগছে। সরকার থেকে যখন ঘরে উঠতে বলবে, তখনই গিয়ে উঠব।’
১৭ জানুয়ারি দেপাশাই গিয়ে দেখা গেল, সেখানে এ রকম ৩৫টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সামিউল হক বলেন, তাঁরা দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।
ধামরাইয়ের মতো সারা দেশে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আধা পাকা ঘর দিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ৩৬টি উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে আরও ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মুজিব বর্ষে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করবেন।
প্রথম পর্যায়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীন ২৪ হাজার ৫৩৮টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ কর্মসূচির অধীন ৩৮ হাজার ৫৮৬টি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের অধীন ৩ হাজার ৬৫টি ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। অনেক জায়গায় ঘর নির্মাণ শেষ, অনেক জায়গায় শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে।
গত রোববার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের খলিশা ডোহরা এলাকায় গিয়েও দেখা গেল, নতুন নির্মাণ করা আধা পাকা ঘরগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সদ্য রং লাগানোয় চকচক করছে। বিদ্যুতের তারও লেগেছে। সাটুরিয়ার ইউএনও আশরাফুল আলম বলেন, সুবিধাভোগীদের ঘরগুলো বুঝিয়ে দিতে সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের সমন্বয়ে এই কাজ চলছে। প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, দেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তাঁর উদ্যোগে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। একসঙ্গে এত ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর করে দেওয়ার ঘটনা বিরল।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে দেশে দুই ধরনের মানুষকে ঘর করে দেবে সরকার। প্রথমত, যাঁরা ভূমিহীন ও গৃহহীন। আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁদের ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত জমি আছে, কিন্তু ঘর নেই কিংবা থাকলেও একেবারে জরাজীর্ণ। গত বছরের জুন পর্যন্ত এই দুই ধরনের মানুষের তালিকাও করা হয়েছে। এর মধ্যে ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি। অন্যদিকে অল্প জমি আছে, কিন্তু ঘরহীন বা থাকলেও জরাজীর্ণ—এমন পরিবার আছে ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি।
প্রথম পর্যায়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীন ২৪ হাজার ৫৩৮টি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ কর্মসূচির অধীন ৩৮ হাজার ৫৮৬টি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন গুচ্ছগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের অধীন ৩ হাজার ৬৫টি ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। অনেক জায়গায় ঘর নির্মাণ শেষ, অনেক জায়গায় শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ে গৃহ নির্মাণের জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। প্রতিটি ঘরের জন্য ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়ার এই উদ্যোগ খুবই ভালো। এটিকে এককালীন সামাজিক সহায়তা হিসেবে না দেখে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আরও কিছু করা দরকার।হোসেন জিল্লুর, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন
ইউএনওদের নেতৃত্বে কমিটির মাধ্যমে কাজটি হচ্ছে। ব্যারাক নির্মিত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে। খাসজমিতে গৃহহীনদের ঘরগুলো হচ্ছে।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার ইউএনও মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, রায়পুরায় ৩৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও স্কাউটের সদস্যসহ স্থানীয় মানুষদের মাধ্যমে যাচাই করে সুবিধাভোগী ঠিক করা হয়েছে।
‘বাড়িঘর পামু, আমরা খুব আনন্দ পাইছি’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় মোট ১০২টি ঘর হবে। প্রথম ধাপে ২৪টি ঘর প্রস্তুত হয়েছে। এর মধ্যে চুন্টা ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে ১৭টি এবং বিটঘর গ্রামের ৭টি।
উপজেলা সদর থেকে নরসিংহপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৭ জানুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৭টি ঘরের নির্মাণকাজ শেষে রং লাগানোসহ শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে।
এই গ্রামের উপকারভোগীদের একজন আনোয়ারা বেগম (৬৫)। স্বামী আলী আহমেদের ৪ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি ছিল। কিন্তু ১৬ বছর আগে কিছু আত্মীয়স্বজন কৌশলে ওই বাড়ি দখলে নিয়েছেন। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে চার ছেলে ও তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিনি অসুস্থ স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকেন আজবপুর বাজারের একটি খুপরিঘরে। বাজারে পিঠা বিক্রির আয় দিয়ে চলে তাঁদের সংসার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে ভাবছি না কোনো দিন নিজের বাড়ি আর ঘর অইব। বাড়িঘর পামু, আমরা খুব আনন্দ পাইছি।’
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, দেশে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রকল্প হাতে নেয়। শুরু থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যারাকে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৬৮টি ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আর যার জমি আছে ঘর নেই, এমন ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৪টি পরিবারকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর বলেন, ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়ার এই উদ্যোগ খুবই ভালো। এটিকে এককালীন সামাজিক সহায়তা হিসেবে না দেখে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আরও কিছু করা দরকার।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সরাইল প্রতিনিধি বদর উদ্দিন)