ব্যতিক্রমী মিষ্টি

গয়ানাথের বালিশ

নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি। ছবি: প্রথম আলো
নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি।  ছবি: প্রথম আলো

‘জাম, রসগোল্লা পেয়ে শ্বশুর করল চটে নালিশ/কথা ছিল আনবে জামাই “গয়ানাথের বালিশ”’

বালিশের ওপর মাথা রেখে আমরা নিদ্রা যাই। কিন্তু নেত্রকোনায় আরেক ধরনের বালিশ আছে, যা তুলা দিয়ে তৈরি নয়। এটিও তুলতুলে, তবে তা মাথায় না দিয়ে খাওয়া হয়।
জেলা শহরের গয়ানাথ ঘোষ নামের এক ব্যক্তি বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির উদ্ভাবক। তাই এটি গয়ানাথের বালিশ নামে পরিচিত। বালিশ মিষ্টি নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত লোকছড়া দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছে।
বহু বছর আগে নেত্রকোনা শহরের বারহাট্টা সড়ক এলাকায় ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামের মিষ্টির দোকান ছিল। গয়ানাথের স্বপ্ন ছিল নতুন মিষ্টি তৈরি করার। একদিন তিনি বিশাল আকারের কয়েকটি মিষ্টি তৈরি করলেন। ক্রেতাদের প্রশংসা পেলেন। মিষ্টিটির আকার অনেকটা কোলবালিশের মতো। তাই এটির নাম রাখা হলো বালিশ মিষ্টি। স্বাদে অতুলনীয়। অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়ে এর সুনাম। একসময় গয়ানাথের নামটিও জড়িয়ে যায় মিষ্টিটির সঙ্গে। এখন জেলা শহরের আট-নয়টি দোকানসহ বিভিন্ন উপজেলায় বালিশ মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হয়।
এক কারিগর জানালেন, প্রথমে ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। এ মণ্ড দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন আকারের বালিশ। পরে তা ঘণ্টাখানেক ভাজা হয় চিনির গরম রসে। এরপর ঠান্ডা করে চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ। বিক্রির সময় বালিশের ওপর দেওয়া হয় ক্ষীরের প্রলেপ বা দুধের মালাই। মিষ্টি সুস্বাদু করতে আরও কিছু কলাকৌশল প্রয়োগ করেন কারিগরেরা। এগুলো প্রকাশ করতে চান না কেউ। বর্তমানে এ মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর রতন পাল। তাঁকে সহযোগিতা করেন ১০ জন কারিগর।
রতন পাল জানালেন, গাভির খাঁটি দুধ ছাড়া বালিশ তৈরি করা সম্ভব নয়। পাঁচ কেজি দুধে এক কেজি ছানা হয়। ৩০০ টাকা দামের একটি বালিশ তৈরি করতে ৪৫০ গ্রাম ছানা লাগে।
বালিশ মিষ্টির উদ্ভাবক গয়ানাথ ঘোষ ১৯৬৯ সালে ভারতে চলে যান। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি কুমুদ চন্দ্র নাগের কাছে বিক্রি করেন। কুমুদ ছয় বছর পর বালিশ তৈরির প্রধান কারিগর নিখিল মোদকের কাছে তা বিক্রি করেন। নিখিলের মৃত্যুর পর এটি পরিচালনা করছেন তাঁর তিন ছেলে বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক।
দিলীপ মোদক বলেন, তাঁরা এখন একই নামে শহরে তিনটি দোকান চালান। ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টি এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অভিজাত দোকানগুলোয় সরবরাহ করা হয়। অনেকে দেশের বাইরেও নিয়ে যান।
আগে সস্তা দামে যে বালিশ পাওয়া যেত, এখন সেটা নেই। এখন ৫ টাকা, ১০ টাকা মূল্যের কোনো বালিশ নেই। বর্তমানে ২০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের বালিশ তৈরি হয়। ৩০০ টাকা মূল্যের বালিশ আকারে ১ ফুট থেকে ১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। ওজন এক কেজি থেকে দুই কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে বিয়ে, জন্মদিনসহ প্রায় সব অনুষ্ঠানে সাধারণত বালিশ বাদ পড়ে না।
জানতে চাইলে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের আরেক স্বত্বাধিকারী খোকন মোদক প্রথম আলোকে বলেন, মিষ্টি তৈরি করা হয় বারহাট্টা সড়ক এলাকার আদি প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় তলায়। এখান থেকেই অন্যান্য দোকানে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, ‘সবকিছুরই খরচ বেড়েছে। তবু আমরা গুণগত মান বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’