গ্রামবাসীর মুচলেকা, 'আর কখনো পাখি শিকার করব না'

নাটোরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া অসহায় পাখি শিকার করে খাওয়ার ঘটনা তদন্তে ইউএনও, বন, প্রাণিসম্পদ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা। আজ শুক্রবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
নাটোরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া অসহায় পাখি শিকার করে খাওয়ার ঘটনা তদন্তে ইউএনও, বন, প্রাণিসম্পদ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা। আজ শুক্রবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

‘আর কখনো পাখি শিকার করব না, পাখিদের নিরাপত্তা বিধান করব’ মর্মে লিখিত মুচলেকা দিল নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাজিতপুর গ্রামবাসী। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ওই গ্রামে ঠাঁই নেওয়া ২০০ শামুকখোল পাখি ধরে রান্না করে খায় গ্রামবাসী।

এ নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গতকাল ‘ঝড়ে অসহায় পাখিগুলো রান্না করে খেল গ্রামবাসী’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশের পর তৎপর হয় স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ, প্রাণিসম্পদ বিভাগ, র‍্যাব ও পুলিশ। আজ শুক্রবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে তারা রান্না করা পাখির মাংস জব্দ করে এবং গ্রামবাসীর কাছ থেকে লিখিত মুচলেকা আদায় করে।

আজ বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহীর বিভাগীয় বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবীর, বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনোয়ার পারভেজ ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার কণ্ডু বাজিতপুর গ্রামে যান। তাঁরা শুরুতেই গ্রামবাসীর কাছে জানতে চান, কারা কারা পাখি শিকার করেছেন। তাতে কেউ সাড়া না দেওয়ায় বড়াইগ্রাম থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি চালান।

এ সময় বেলাল হোসেন নামের একজনের বাড়ি থেকে রান্না করা মাংস উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ওই মাংস মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। পরে কর্মকর্তারা গ্রামের শিমুলতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, পাখিসহ বন্য প্রাণী শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। পাখিদের নিরাপদে বসবাসের ব্যাপারে গ্রামবাসীর সহযোগিতাও চান তাঁরা। এ সময় গ্রামের কেউ কেউ এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

বড়াইগ্রাম ইউএনও জানিয়েছেন, যাঁরা পাখিগুলো ধরে রান্না করে মাংস খেয়েছেন, তাঁদের ছাড়া হবে না। প্রকাশ্যে তাঁদের ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। তাঁরা তা করেননি। এখন গোপনে তদন্ত চলছে। যাঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ শুরু করেছে।

প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গ্রাম থেকে চলে আসার পর নাটোর র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার রাজিবুল আহসানের নেতৃত্বে র‍্যাবের একটি দল ওই গ্রামে যান। তাঁরা গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। র‌্যাব অধিনায়ক রাজিবুল ইসলাম জানান, পাখিশিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পাশাপাশি ওই গ্রামে পাখিরা যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সে ব্যাপারেও তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।

নাটোরের বড়াইগ্রামের বাজিতপুর গ্রামের তিনটি শিমুলগাছে ঠাঁই নেওয়া দুই শতাধিক শামুকখোল পাখি গতকাল ভোরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে উড়তে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় সুযোগসন্ধানী কিছু লোক পাখিগুলো বাড়িতে ধরে নিয়ে যান। পরে সেগুলো জবাই করে মাংস রান্না করে খান।

ওই গ্রামের তরুণ আব্দুল কাদের পাখিগুলো তিন মাস ধরে পাহারা দিয়ে আসছিলেন। পাখিগুলোর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটি তিনি প্রথম আলোকে জানান। এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে বিপুলসংখ্যক পাঠক প্রতিবেদনটি পড়ে তাঁদের মন্তব্য তুলে ধরেন।

শামুকখোল পাখির পরিচয়

শামুকখোল পাখি।

শামুকখোল বড় আকারের জলচর পাখি। ঠোঁট বড় ও পাশ থেকে খানিকটা চাপা। এই পাখির প্রধান খাদ্য শামুক। দুই ঠোঁটের ফাঁকের মধ্যে শামুক ভাঙায় এরা বিশেষ পারদর্শী। এ জন্যই এই পাখির স্থানীয় নামকরণ হয়েছে শামুকখোল। শামুকভাঙা নামেও এরা পরিচিত। এরা মূলত এশিয়ান শামুকখোল (Asian Openbill)। বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans।

এরা সাইকোনিডি গোত্রের এক প্রজাতির পাখি। আকারে এরা বেশ বড়। অনেকটা শকুনের মতো। এদের আরেকটি প্রজাতি হলো আফ্রিকান শামুকখোল। এরা ভোরবেলায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। পানির ধারে বা অল্প পানিতে হেঁটে হেঁটে কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে শামুক, ঝিনুক আর গুগলি তুলে খায়।

পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, শামুকখোল মূলত হাওর, বিল বা এই জাতীয় বড় জলাশয়ের ধারেকাছে থাকে। এরা কখনো ছোট ঝাঁক বেঁধে, কখনোবা একত্রে দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। সাধারণত খাবারের অভাব না হলে এরা স্থান পরিবর্তন করে না। বাসা বাঁধার সময় এরা পানকৌড়ি ও বকের সঙ্গে মিলে বিরাট কলোনি গড়ে তোলে। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে এদের দেখা যায়। এরা দূরদূরান্ত পরিভ্রমণ করতে পারে। এর আগে বিজ্ঞানীরা থাইল্যান্ডে রিং পরানো আরেকটি পাখিকে দেড় হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে বাংলাদেশে পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮১ সেন্টিমিটার। ঠোঁট ও পা লম্বা। দুই ঠোঁটের মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকে। এই ফাঁকের ভেতরে শামুক বা শামুকজাতীয় বস্তু ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলে ভেতরের জীবন্ত অংশটুকু খেয়ে নেয়।

এই পাখির পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকমের। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের প্রজননকাল। এ সময় তারা উঁচু গাছে ডালপালা দিয়ে বড় মাচার মতো বাসা বাঁধে। ২ থেকে ৫টি ডিম দেয়। ডিমের রং সাদা। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই ডিমে তা দেয়। ২০ থেকে ২৫ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।