অনুশীলনে ব্যস্ত গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি মাগুরা শ্রীপুরের গোয়ালদহে
অনুশীলনে ব্যস্ত গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি মাগুরা শ্রীপুরের গোয়ালদহে

গোয়ালদহের মেয়েদের স্বপ্ন

চোখে একরাশ স্বপ্ন। চেহারায় আত্মবিশ্বাস। মাগুরা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একঝাঁক মেয়ে ফুটবল খেলে জিতে নিয়েছে স্থানীয় মানুষের হৃদয়।

৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে শেষ হয়েছে জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাগুরা জেলা দল, আর মাগুরাকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা রেখেছে গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা। মাগুরা জেলা দলের ১২ ফুটবলারের ১০ জনই এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী।

গত বছরও এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মাগুরা। অবশ্য গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা ট্রফি জেতাটাকে যেন অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছে! এ বছরের জুনে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে খুলনা বিভাগের চ্যাম্পিয়ন মাগুরা। এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমসের মেয়েদের ফুটবলেও শিরোপা জিতেছে গোয়ালদহ স্কুলের মেয়েদের নিয়ে গড়া মাগুরা জেলা দলই। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে খুলনা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল গোয়ালদহ স্কুলের মেয়েরা।

২০১২ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলার শুরু এই মেয়েদের। প্রথম দুই বছর সাফল্য আসেনি, তবে ২০১৪ সালে খুলনা বিভাগে রানার্সআপ হয় গোয়ালদহ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে খুলনা বিভাগে রানার্সআপ হয়েছে মাগুরা। এরপর টানা দুই বছর চ্যাম্পিয়ন।

এই মেয়েদের সাফল্যের পেছনে নেই কোনো পেশাদার কোচের ভূমিকা। এর পেছনের কারিগর আসলে গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি ও সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। তাঁরাই স্কুল শেষে নিয়মিত অনুশীলন করান মেয়েদের। শুরুতে এলাকার অনেক মানুষ চাইতেন না মেয়েরা ফুটবল খেলুক। নানা নেতিবাচক কথা শুনতে হতো। পাওয়া যেত না কোনো আর্থিক অনুদানও। প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতির কথায়, ‘খেলার সরঞ্জামের পাশাপাশি অনুশীলন শেষে মেয়েদের নাশতার ব্যবস্থা আমরাই করেছি। এদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। ওরা যাতে ভালোভাবে খেলতে পারে, সেই চেষ্টা সব সময় ছিল আমাদের।’

এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখন অভিভাবকেরাই আসেন শিক্ষকদের কাছে। বলেন, ‘স্যার, আমার মেয়েকেও ফুটবল খেলাতে চাই।’ স্থানীয়ভাবেও কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এই মেয়েদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।

৭ গোল করে জেএফএ কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছে বৃষ্টি মণ্ডল। তার চোখে এখন জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন, ‘আমার পরিবার কখনো খেলতে বাধা দেয়নি। তবে এলাকার অনেকে বলত, মেয়ে হয়ে কেন ফুটবল খেলি? আমি কখনো ওদের কথা পাত্তা দিইনি। ফুটবল খেলতে ভালো লাগে আমার। যারা আমাদের খেলা পছন্দ করত না, তারাও এখন প্রশংসা করে।’

গোয়ালদহের কিছু মেয়ের সামনে এখন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী।

কিছু বাস্তব সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। গোয়ালদহ স্কুলের মাঠটি প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ছোট। স্কুলের সাবেক ও বর্তমান অনেক মেয়েই ছোট্ট ওই মাঠে অনুশীলন করে। জেএফএ কাপের সেরা উদীয়মান ফুটবলার দীপা মণ্ডলের কথায়, ‘মাঠটা আরেকটু বড় হলে আরও ভালোভাবে অনুশীলন করতে পারতাম। অনুশীলনে এখন আগের চেয়ে অনেক মেয়ে আসে। ছোট মাঠে খেলতে অসুবিধাই হয় আমাদের।’ অনুশীলনের জন্য বড় মাঠের প্রয়োজনের কথা বলেছেন সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলামও।

মাঠের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন মাগুরার জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম। বলেছেন, ‘এই মেয়েদের ঘিরে ফুটবলে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাতে একটা খেলার মাঠ খুবই জরুরি। এটা এলাকাবাসীরও দাবি। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’