প্রভাবশালীদের তদবির ও লেনদেনের মাধ্যমে লটারি ছাড়াই রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ২৮১টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো জায়গায় পড়েছে; যেমন লেকের পাশে কিংবা দক্ষিণ বা দক্ষিণ–পূর্বমুখী। লটারি না করে অত্যন্ত গোপনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়াকে নিয়মের লঙ্ঘন এবং অনৈতিক বলছেন রাজউকেরই কিছু কর্মকর্তা।
লটারি না করে এভাবে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে (১৮ নম্বর সেক্টর)। ‘নিম্ন ও মধ্যম’ আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য ২০১০ সালে এই প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পে মোট ৭৯টি ১৬ তলা ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট আছে। ২০১২ সালে প্রথম এই প্রকল্পের আওতায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিতে আবেদন আহ্বান করে রাজউক। এরপর বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় ফ্ল্যাট বরাদ্দের আবেদন নেওয়া হয়।
প্রচলিত প্রথার ব্যত্যয় ঘটিয়ে লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া ঠিক হয়নি। যাঁরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।গোলাম রহমান, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি
লটারি ছাড়াই ফ্ল্যাট বরাদ্দের ঘটনাটি গোপনে গত দুই বছরের মধ্যে ঘটেছে। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় গত নভেম্বর মাসে। ওই মাসের ২২ তারিখ প্রকল্প এলাকার আটটি ভবনের ৩০৬টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য অনলাইনে লটারি হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মিলনায়তনে। ওই আট ভবনে মোট ফ্ল্যাট আছে ৬৭২টি (প্রতি ভবনে ৮৪টি)। লটারিতে অংশ নেওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত ছিলেন ৩০৬ জন আবেদনকারী। নিয়ম অনুযায়ী, ৩০৬ জন আবেদনকারীর মধ্যে লটারি হওয়ার কথা ছিল ৬৭২টি ফ্ল্যাটের বিপরীতে। অর্থাৎ আবেদনকারীরা আটটি ভবনের ৬৭২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে যেকোনো একটি ফ্ল্যাট পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু অনলাইনে লটারি হয়েছে ৩৯১টি ফ্ল্যাটের বিপরীতে। বাকি ২৮১টি ফ্ল্যাট যাঁদের নামে বরাদ্দ হয়েছে, সে তালিকা লটারি হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই চূড়ান্ত করা হয়। বিষয়টি রাজউকের একটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
এভাবে লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দে আপত্তি জানিয়েছেন সর্বশেষ লটারিতে বরাদ্দ পাওয়া দুজন আবেদনকারী। তবে রাজউক হয়রানি করতে পারে, এই আশঙ্কায় তাঁরা নাম প্রকাশে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, রাজউকের এই আচরণ অন্যায়। তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পুনরায় লটারি করার দাবি জানান তাঁরা।
৭৯টি ১৬ তলা ভবনে ফ্ল্যাট আছে ৬ হাজার ৬৩৬টি। এখনো প্রায় এক হাজার ফ্ল্যাটের বরাদ্দ হয়নি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন দফা লটারিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়েছে। গত নভেম্বরে চতুর্থ দফার লটারি নিয়ে অনিয়ম হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের একজন কর্মকর্তা বলেন, লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দের কোনো নিয়ম নেই। দেড়-দুই বছর ধরে রাজউকের বোর্ড সভার মাধ্যমে এই অনিয়ম করা হয়েছে। এর ফলে লটারিতে যিনি লেকের পাশে কিংবা দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাট পেতে পারতেন, তিনি সেই সুযোগ হারিয়েছেন, এককথায় তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কারণ, অবস্থানভেদে ফ্ল্যাটের দামের কোনো পার্থক্য নেই। নিচতলার উত্তরমুখী ফ্ল্যাট কিংবা লেকের পাশে দক্ষিণমুখী আটতলার ফ্ল্যাটের দামও এক।
রাজউকের আরেক কর্মকর্তা বলছেন, ওই ২৮১টি ফ্ল্যাটের মধ্যে এমন আবেদনকারীও রয়েছেন, যিনি আগে কোনো এক লটারিতে প্রকল্প এলাকায় একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু ফ্ল্যাটের অবস্থান তাঁর পছন্দ হয়নি। পরে তদবির করে পছন্দমতো ফ্ল্যাট নিয়েছেন।
রাজউকের বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন সংস্থার চেয়ারম্যান। এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন সাঈদ নূর আলম। লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
ফ্ল্যাট বরাদ্দের প্রক্রিয়া
রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পগুলোর মধ্যে উত্তরার প্রকল্পটিই আকারে সবচেয়ে বড়। এখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ১ হাজার ৬২০ বর্গফুট (৩৭০ বর্গফুট কমন স্পেসসহ)। ৭৯টি ভবনের মধ্যে ৫৯টি ভবনের ফ্ল্যাট বরাদ্দের কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে রাজউক। আর বাকি ২০টি ভবনের মধ্যে ১৪টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ছয়টি ভবনের নির্মাণকাজ এখনো চলছে। এখন একটি ফ্ল্যাট কিনতে দাম পড়ে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা। কিস্তিতে এই টাকা শোধের সুযোগ আছে। ২৫ বছরের বেশি বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক (আয় করেন) কিছু শর্ত মেনে আবেদন করতে পারেন।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে তিনটি লটারি হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত তিন লটারির মাধ্যমে ৪ হাজার ২৯৮টি ফ্ল্যাটের বিপরীতে আবেদনকারীদের ফ্ল্যাট আইডি দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় অনিয়ম। প্রভাবশালীরা তদবির করে বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পছন্দমতো ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিতে থাকেন।
ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যম বা রাজউকের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদনপত্র আহ্বান করে রাজউক। আবেদনের পর সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর যোগ্যদের সাময়িক একটি বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়। তবে সাময়িক বরাদ্দপত্রে কে কোন ভবনের কত নম্বর ফ্ল্যাট পেলেন, তা উল্লেখ থাকে না। বরাদ্দপত্র পেলেই চার কিস্তির টাকা (ফ্ল্যাটের মোট দামের প্রায় অর্ধেক) শোধ করতে হয়। এরপর লটারির মাধ্যমে আবেদনকারীকে ফ্ল্যাট আইডি (ভবন ও ফ্ল্যাটের নম্বর) দেওয়া হয়। রাজউকের বোর্ডে এটি পাসের পর চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়।
গত ২২ নভেম্বর লটারিতে যে ৩০৬টি ফ্ল্যাটের আইডি দেওয়া হয়েছিল, তার চূড়ান্ত অনুমোদন রাজউকের আজ রোববারের বোর্ড সভায় হতে পারে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে তিনটি লটারি হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত তিন লটারির মাধ্যমে ৪ হাজার ২৯৮টি ফ্ল্যাটের বিপরীতে আবেদনকারীদের ফ্ল্যাট আইডি দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় অনিয়ম। প্রভাবশালীরা তদবির করে বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পছন্দমতো ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিতে থাকেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত প্রথার ব্যত্যয় ঘটিয়ে লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া ঠিক হয়নি। যাঁরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।