রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বায়ান্নয় রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাঙালি। সে সময়ে যাঁরা যুক্ত ছিলেন সেই আন্দোলনে, তাঁদের নিজ চোখে দেখা ঘটনা।
আমাদের লক্ষ্য ছিল, পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়া। যখন সোজা পথে পুলিশ যেতে দিল না, তখন দেখা যাক, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ পেরিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়া যায় কি না। আমার একবার মনে হয়েছিল যে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আমরা জমায়েত হলে সেখানে না পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে—তাতে রোগীদের কষ্ট বাড়বে। সৌভাগ্যবশত হাসপাতালের প্রাঙ্গণে কেউ বেশিক্ষণ থাকেনি—সবাই চলে যাচ্ছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দিকে। তারই মধ্যে কেউ কেউ আবার পুলিশের দিকে কিছু না কিছু নিক্ষেপ করছিল। ওদিকে পরিষদের অধিবেশনের সময় হয়ে যাচ্ছে। ওই পথেই এমএলএরা যাচ্ছেন অধিবেশনে যোগ দিতে। আমরা চাইছি পরিষদ ভবনে যেতে এবং গমনরত এমএলএদের ধরে একটা কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে। হোস্টেলের গেট দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করতেই লাঠিচার্জ, তারপর কাঁদানে গ্যাসও।
গুলি চালনার পর কেমন একটা থমথমে ভাব নেমে এল। জানতে পারলাম, ফররুখ আহমদের নেতৃত্বে ঢাকা বেতারের সব স্টাফ আর্টিস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, অন্যান্য অফিস ত্যাগ করে চলে এসেছেন কর্মচারী-কর্মকর্তারা। রেলওয়ে শ্রমিকেরাও ধর্মঘট করেছেন বলে শোনা গিয়েছিল, তবে সম্ভবত সে ধর্মঘট হয়েছিল পরদিন।
১২-১৩ বছরের একটি ছেলের পায়ে টিয়ার গ্যাসের শেল লেগে ক্ষতের সৃষ্টি হলে সে পড়ে যায়। আমি আরেকজনের সাহায্যে রেলিংয়ের ওপারে অন্যদের হাতে তাকে তুলে দিই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উত্তেজনা বাড়ছে, আমরা এগিয়ে যাই, আবার পুলিশের তাড়া খেয়ে ফিরে আসি। এ রকম অগ্র-পশ্চাৎ করার মধ্যে প্রথমে মুর্তজা বশীরের সঙ্গে এবং পরে আলাউদ্দিন আল আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। গুলি চলতে পারে, এই আশঙ্কা ব্যক্ত করে আজাদ আমাকে সাবধানে থাকতে বলেন। গুলি চলার আশঙ্কা আমার মনে প্রত্যয় জাগায়নি। পরে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন এই বলে যে গুলি চালনার পূর্বমুহূর্তে নাকি লাল পতাকা নেড়ে ইশারা দেওয়া হয় এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর কাছে লাল পতাকা তিনি দেখেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত বেলা তিনটার একটু পরে গুলি চলল। একটু পরপরই একেকজনের মৃত্যুর সংবাদ—কখনো বা নিছক গুজব—ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রথমে তিনজন শহীদের নাম আমরা শুনি—আবুল বরকত, সালাহউদ্দিন ও সালাম। পরে বোঝা যায়, রফিকউদ্দীনকেই ভুল করা হয়েছিল সালাহউদ্দিন বলে—তার মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। আমানুল হক সে ছবি তুলেছিলেন এবং পরে তা ছাপিয়ে প্রচার করা হয়েছিল।
কীভাবে যেন মেডিকেল কলেজের ১১ নম্বর ব্যারাকে একটা মাইক্রোফোন এনে বসানো হলো। মোহাম্মদ তোয়াহার বাংলায় বক্তৃতা করার অভ্যাস ছিল না। তিনি আমাকে বললেন লিখে দিতে এবং সেটা দেখে তিনি পড়তে থাকলেন। কিন্তু মুখের কথার সঙ্গে লেখার গতির মিল হয় না। সুতরাং একসময় লেখায় টান পড়ল—তোয়াহা ভাই এক-আধটা কথা যোগ করে বক্তব্য শেষ করে আমাকে মাইক্রোফোন দিলেন। বক্তৃতার অভ্যাস আমারও ছিল না কোনো ভাষাতেই। কয়েক বছর আগে পুলিশ ধর্মঘটের সময়ে সেনাবাহিনীকে দিয়ে পুলিশের ওপরে গুলি চালনা করা হয়েছিল। সেই কথার উল্লেখ করে, মাতৃভাষার দোহাই দিয়ে, পুলিশের উদ্দেশে কিছু বললাম।
গুলিবর্ষণের পরপরই হাসান হাফিজুর রহমান নিজের উদ্যোগে একটি প্রচারপত্র লিখে ছাপিয়ে ফেলেন সেই দিনেই। তাতে গুলি চালনার জন্য দায়ী করা হয় মন্ত্রী মফিজউদ্দীন আহ্মদকে। আমার জানামতে, গুলি চালনার প্রতিবাদে লেখা প্রথম প্রচারপত্র ছিল ওটাই। আবেগতাড়িত ওই প্রচারপত্রের বক্তব্য খণ্ডন করে ২৩ ফেব্রুয়ারিতে বিবৃতি দিয়েছিলেন মফিজউদ্দিন—তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার পরদিন। পরে জেনেছি, আবদুল্লাহ আল-মুতীর উদ্যোগে ও আহমদ হোসেনের সাহায্যে যে প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় ২৭ বা ২৮ তারিখে—তাতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ মুদ্রিত হয়।
গুলি চালনার পর কেমন একটা থমথমে ভাব নেমে এল। জানতে পারলাম, ফররুখ আহমদের নেতৃত্বে ঢাকা বেতারের সব স্টাফ আর্টিস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, অন্যান্য অফিস ত্যাগ করে চলে এসেছেন কর্মচারী-কর্মকর্তারা। রেলওয়ে শ্রমিকেরাও ধর্মঘট করেছেন বলে শোনা গিয়েছিল, তবে সম্ভবত সে ধর্মঘট হয়েছিল পরদিন।
একটু পরেই সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এসে পড়ল, ঘোষণা শোনা গেল সান্ধ্য আইন জারির। সান্ধ্য আইন কার্যকর হওয়ার আগে বাড়ি ফেরা দরকার। কলাভবন-মেডিকেল কলেজের পেছনে রেললাইন ধরে নবাবপুরের দিকে রওনা হলাম। বাড়িতে যখন পৌঁছালাম, তখন অবসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছি। আমার জন্য বাপ-মায়ের উদ্বেগও আমাকে আর স্পর্শ করছে না।
কাল নিরবধি (সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৬) থেকে সংক্ষেপিত
আনিসুজ্জামান (১৪ মে, ২০২০-১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭): প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক; গবেষক, লেখক।