গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পদ আটকা, সংকটে পরিবার

■ ১০ বছরে গুমের শিকার ৫৫৩ জন।

■ কোনো ব্যক্তি টানা সাত বছর নিখোঁজ থাকলে আদালত তাঁর পরিবারকে ব্যাংকের টাকা ওঠানো ও সম্পদ বণ্টনের অনুমতি দিতে পারেন।

বাবা পারভেজ হোসেনকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে আসেন স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে

কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন ২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজারের কাছে থাকা নিজের দোকান থেকে দুপুরের খাবার খেতে বেরিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। ওই এলাকার সিসি ক্যামেরার সারা দিনের ফুটেজ পাওয়া গেছে। শুধু পাওয়া যায়নি দুই ঘণ্টার ফুটেজ, যে সময়টিতে তিনি দোকান থেকে বের হন।

ইসমাঈল হোসেনের স্ত্রী নাসরীন জাহান এখন ১৫ বছরের মেয়ে আর ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন। নিজে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেটা বন্ধ। নাসরীন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামীর ব্যাংক হিসাবে কিছু টাকা জমা ছিল। স্থায়ী আমানতও ছিল। তিনিই নমিনি (মৃত্যুর পর টাকা পাওয়ার জন্য মনোনীত)। তবে ব্যাংক বলেছে, তাঁর স্বামী জীবিত না মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকা তিনি পাবেন না।

মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৫৫৩ জন। তাঁদের কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। কেউ উদ্ধার হয়েছেন সীমান্তের ওপার থেকে। কারও লাশ পাওয়া গেছে পরে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ তুলছে। যাঁরা এখনো নিখোঁজ, তাঁদের পরিবারের বিপদ অন্য রকম। সেটি হলো নিখোঁজ ব্যক্তির নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমানো টাকা তুলতে না পারা এবং সম্পদও বুঝে না পাওয়া।

এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ রোববার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে আসছে। এর আগে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ গ্রহণ করে এবং ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে।

দিবসটি সামনে রেখে গতকাল শনিবার ছয়টি পরিবারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর, যাঁদের স্বজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ছিলেন। তাঁদের কারও ব্যাংকে টাকা জমা আছে, কারও স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ও কারও বিমা করা আছে। কিন্তু গুম হওয়ার পর পরিবার আর টাকা ও বিমার দাবি বুঝে পাননি। সম্পদ কেনাবেচা ও বণ্টনে আইনগত জটিলতা তৈরি হয়েছে।

আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি টানা সাত বছর নিখোঁজ থাকার পর আদালত তাঁর পরিবারকে ব্যাংকে জমা টাকা ওঠানো ও সম্পদ বণ্টনের অনুমতি দিতে পারেন। এ জন্য পরিবারকে আদালতে যেতে হয়। আইনি নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, সাত বছর একজন মানুষ নিখোঁজ থাকার পর তিনি আর ফিরবেন না বলে ধরে নেওয়া হয়।

পরিবারগুলো ব্যাংকে জমা টাকা তুলতে ও সম্পদ বণ্টন করতে পারছে না। অনেকের দিন কাটছে কষ্টে।

তার আগে ব্যাংক থেকে টাকাপয়সা তোলা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বণ্টনে সমস্যা থাকে। আদালত বিশেষ বিবেচনায় পরিবারগুলোকে জমানো টাকার কিছু অংশ তোলার অনুমতি দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, পরিবারগুলো আশা করে থাকে গুম হয়ে থাকা স্বজন ফিরে আসবেন। তাঁরাও অনেক সময় আদালতে যান না। অপেক্ষা করতে থাকেন।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারও কারও স্বজন বলছেন, আইনি যে প্রক্রিয়া, তা অনুসরণ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। কারও ক্ষেত্রে সাত বছর হয়নি, কিন্তু পরিবার ভীষণ আর্থিক সংকটে রয়েছে।

২০১২ সালে এপ্রিলে বিএনপির নেতা এম ইলিয়াস আলীর সঙ্গে নিখোঁজ হন তাঁর গাড়িচালক আনসার আলীও। গাড়িটি পাওয়া যায় রাজধানীর মহাখালীতে। আট বছরে ইলিয়াস আলী ফেরেননি, আনসার আলীও নন। ইলিয়াস আলীর পরিবারে আর্থিক সংকট ততটা নেই, যতটা আনসার আলীর পরিবারে রয়েছে। তাঁর স্ত্রী মুক্তা বেগম এখন সিলেট সিটি করপোরেশনে ছোট চাকরি করেন। ১১ বছরের মেয়ে স্কুলে পড়ে। মুক্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে নমিনি হিসেবে রেখে দুই হাজার টাকা করে ব্যাংকে জমাতেন আনসার। সেই টাকা এখন আর তুলতে পারছেন না।

ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবার নামে থাকা ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়ে আছে। তাঁর মা তাহসিনা রুশদীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। নিজেদের বাড়ি আছে। একটা সময় কষ্টে পড়ে গেলেও এখন অবস্থা স্থিতিশীল। তাঁরা চান তাঁদের বাবার যে যে জিনিস যেভাবে আছে, সেভাবেই থাক। একদিন হয়তো তিনি ফিরে আসবেন।

কুমিল্লার লাকসামের সাবেক সাংসদ ও বিএনপির নেতা সাইফুল ইসলাম (হিরু) ও দলটির আরেক নেতা হুমায়ুন কবির (পারভেজ) গুম হন ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর। লাকসাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় যাওয়ার পথে তাঁদের দুজনকে কুমিল্লা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১৯ জনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল পুলিশ। বিস্তারিত তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে সিআইডির ওপর। সেই তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, গুম হয়ে থাকা দুজনও ফেরেননি।

সাইফুল ইসলামের আইনজীবী বদিউল আলম (সুজন) প্রথম আলোকে বলেন, লাকসামে সাইফুল ইসলামের আটা ও ভোজ্যতেলের মিল ছিল। ব্যাংকঋণ ছিল। এখন প্রায় সাত বছর হয়ে যাওয়ায় ধরে নেওয়া যায়, সাইফুল ইসলাম আর ফিরবেন না। এই দাবি নিয়ে আদালতে যাওয়ার আগের যে প্রক্রিয়া, সেটা বেশ জটিল। সাইফুলের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কর দেওয়া, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করাসহ অনেক কাজ, অনেক জটিলতা।

সাইফুলের সঙ্গে গুম হওয়া হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার চলছেন তাঁর স্বামীর অংশীদারি ব্যবসা থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বামীর দুজন ব্যবসায়ী অংশীদার ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, ব্যবসায় হুমায়ুন কবির যে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, সেই টাকা ধাপে ধাপে তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া হুমায়ুন একটা আবাসন প্রকল্পের জন্য ৪০ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। গুম হওয়ার পর অনেক দিন তাঁরা (জমি কিনতে টাকা দেওয়া ব্যক্তিরা) চুপ করে থাকলেও এখন টাকা ফেরত চাইছেন। শাহনাজ আক্তার বলেন, তিনি জমি বিক্রি করতে পারছেন না। টাকাও ফেরত দিতে পারছেন না। একটি বেসরকারি ব্যাংকে তাঁর স্বামীর কিছু টাকা আছে। সেটা তুলতে পারেননি তিনি।

আসকের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, গুম জঘন্যতম অপরাধ। ক্রসফায়ার, হেফাজতে মৃত্যুর মতো গুমও বিচারবহির্ভূত। প্রশাসনের উচিত এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিরা নিজেরা পালিয়ে আছেন। তাঁরা কি হাজার কোটি টাকা চুরি করেছেন যে পালিয়ে থাকবেন? লুকিয়ে থাকলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাঁদের খুঁজে বের করে না কেন?’