গুম: পরিবারগুলোর তথ্য নিয়ে কী করবে সরকার

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে এভাবে ছবি নিয়ে প্রতিবছর মানববন্ধনে–প্রতিবাদ সভায় হাজির হন ওই ব্যক্তিদের স্ত্রী–সন্তানেরা, তবে তাদের সেই চাওয়া আর পূরণ হয় না  
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলো আইনগত কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি কারও কোনো অভিযোগ আছে কি না, অভিযোগ করে থাকলে বিচারের কী অবস্থা, সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তবে এসব তথ্য দিয়ে এখন কী করা হবে, সে বিষয়ে পুলিশের স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর দৌড়াদৌড়ি করে কোনো ফল না পাওয়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে দায়িত্বশীলদের জোরালো ভূমিকার আশা করে না।

জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটি গুমের শিকার ৭৬ জনের একটি তালিকা পাঠায় সরকারকে। এরপর গত ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাব ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রেক্ষাপটেই শুরু হয়েছিল খোঁজখবর। পুলিশ কাজ গুছিয়ে আনলেও এসব তথ্য দিয়ে তারা কী করবে, সে বিষয় খোলাসা করেনি। আপাতত যে দু–চারজন স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাঁদের কথা বেশি বেশি করে প্রচার করার চেষ্টা আছে তাদের।

কতজনের তথ্য পুলিশ সংগ্রহ করেছে এবং এখন এই তথ্য দিয়ে পুলিশ কী করবে, তা জানতে কথা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস, মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) হায়দার আলী খানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭৬ জনের গুমের একটি তালিকা আমাদের পাঠানো হয়েছে। গুমের অভিযোগ তোলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করেছে।’ তিনি অবশ্য বলেছেন, তাঁদের তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনো শেষ হয়নি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এখন তাহলে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ কী করবে, জানতে চাইলে হায়দার আলী খান বলেন, ‘আমরা আমাদের খোঁজ অব্যাহত রাখব।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বলেছেন, সংগৃহীত তথ্য নিয়ে দফায় দফায় সভা হয়েছে। স্বজনদের দাবিতে যে কর্ণপাত করা হয়নি, তা নিয়েও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে অস্বস্তি আছে।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রণীত গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে বলা হয়েছে, গুম হলো রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, সাহায্য অথবা মৌন সম্মতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি বা এক বা একাধিক ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীর সংগঠিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক, অপহরণ অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য গুমের শিকার ব্যক্তিদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা, তাঁর ভাগ্যে কী ঘটেছে কিংবা তাঁর অবস্থানের তথ্য গোপন করে তাঁকে আইনি রক্ষাকবচের বাইরে রাখা।

বাংলাদেশ এখনো এই সনদে স্বাক্ষর করেনি। তবে মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন যেহেতু পুলিশের কাছে হালনাগাদ সব তথ্য আছে, কাজেই এই ইস্যুকে আর পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। বেশ কিছু মামলায় সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ সাক্ষ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ করেছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া উচিত। না হলে মানবতাবিরোধী এই অপরাধ থেকে জাতির আর মুক্তি নেই।

এখন থানা থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাঁচ শতাধিক মানুষ গুম হয়েছেন। তাঁদের কেউ ফিরে এসেছেন, কারও মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো গুম হয়ে আছেন ১৫৯ জন।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্য ধরে প্রথম আলো ১১টি মামলা ও ৭টি হেবিয়াস করপাস (বেআইনি হেফাজত থেকে হাজির করা) রিট খুঁজে পেয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও বাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী খোঁজখবর করছে।

জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটি ঠিক কোন ৭৬ পরিবারের কথা বলেছে, সে সম্পর্কে পুলিশ তথ্য দিচ্ছে না। একাধিক সূত্র বলেছে, ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে গুম বা ক্ষমতাসীন দলের লোকজন গুম হলেও মূলত তথ্য চাওয়া হচ্ছে বিরোধীদলীয় ও সরকারবিরোধী অবস্থান আছে যাঁদের তাঁদের সম্পর্কে। ফিরে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের বাসায়ও গেছে পুলিশ।

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে তুলে নেওয়া আল আমিন সম্পর্কে খোঁজখবর করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি গুম হন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আল আমিনের বাবা আহমদউল্লাহ প্রথমে ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সে ডায়েরিতে তিনি লেখেন, ছেলের পরনে ছিল জিনস আর ফুলহাতা শার্ট। তিনি বসুন্ধরায় যাওয়ার কথা বলে কড্ডার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। তাঁর গায়ের রং শ্যামলা, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং শনাক্তকরণ চিহ্ন মুখে ব্রণের কালো দাগ।

প্রায় দেড় মাস পর আহাম্মদউল্লাহ অপহরণের মামলা করেন। এজাহারে বাদশাহ নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা উল্লেখ করে তিনি আল আমিন, তানভীর, রাসেলসহ অজ্ঞাতনামা আরও একজনকে অপহরণের তথ্য দেন। আহাম্মদউল্লাহ বলেন, একটি সাদা হায়েস মাইক্রোবাসে করে তাঁদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে।

এর প্রায় দুই বছর পর ওই অপহরণের ঘটনায় হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমনের মা হাজেরা বেগম। আল আমিনের সঙ্গে সেদিন যে ছয়জন গুম হন সাজেদুলও তাঁদের একজন। প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আবেদনকারীর পক্ষে লেখেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কালো পোশাক পরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে সাজেদুলকে আটক করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল তিনটি গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস। তাতে লেখা ছিল র‌্যাব–১।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপহরণের অভিযোগ সত্য, কিন্তু অপহরণকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, এমন মন্তব্য লিখে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এমন বেশ কিছু মামলায় বাদী নারাজিও দিয়েছেন। যেমন কুমিল্লায় ছাত্রলীগ নেতা রকিবুল হাসানের (শাওন) মা আনোয়ারা বেগম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে র‌্যাবের ১৪ জন সদস্য এবং কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শকের বিরুদ্ধে মামলা করেন ২০১৪ সালে।

আনোয়ারার অভিযোগ, রকিবুল হাসানকে র‌্যাব সদস্যরা বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান। এ ঘটনায় রকিবুলের স্ত্রী ফারজানা কোতোয়ালি থানায় প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে পরিবারটি আদালতে মামলা ও হাইকোর্টে রিট করেন। মামলাটি পরিচালনা করছেন আইনজীবী জয়দেব চন্দ্র সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশে কোতোয়ালি থানা মামলার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। তারা বলে, অপহরণের ঘটনা সত্য, তবে আসামি শনাক্ত করা যায়নি। এই প্রতিবেদনে নারাজি দেন বাদী। বছর দুয়েক আগে আদালত গোয়েন্দা বিভাগকে তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুদিন বাদেই মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম (হিরু) ও হুমায়ুন কবির (পারভেজ) গুম হওয়ার ঘটনায় কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছিলেন রংগু মিয়া। হুমায়ুন কবিরের বাবা রংগু মিয়া মামলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল (চাকরিচ্যুত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও তাঁর সহযোগীদের আসামি করেন। এই পরিবারটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও অভিযোগ জানিয়েছিল। বিষয়টি আমলে নিয়ে কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন, বারবার তাগাদাও দেন।

এ মামলার তত্ত্বাবধান করছেন আইনজীবী বদিউল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৩০ বার পিছিয়েছে। প্রথমে কোতোয়ালি থানা তদন্ত করে লেখে, সাক্ষীরা বলেছেন র‌্যাব অপহরণ করেছে। কিন্তু আরও তদন্তের প্রয়োজন। আদালতে বাদী নারাজি দিলে সিআইডি তদন্ত করে বলে, তাঁরা আত্মগোপন করে আছেন কি না দেখা দরকার। নারাজি দেওয়ায় মামলা এখন পিবিআইতে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিবারের সরাসরি অভিযোগ নেই, এমন ঘটনায়ও আসামি শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তবে আগে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তথ্য পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় থানা থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।

যেমন ২০১০ সালে গুম হন হুমায়ুন খান। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় মামলা হয়েছিল। পুলিশ জানিয়েছে, চারবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। ২০১৬ সালে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু অপহরণকারী শনাক্ত হননি। ফেনীর বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান কিংবা আওয়ামী লীগ নেতা সারোয়ার জাহান গুমের ঘটনায়ও পুলিশ একই কথা বলে।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল মুকাদ্দস ও মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, বিএনপির সাংসদ ইলিয়াস আলী, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলাম সুমন, সালাউদ্দিন আহমেদ ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মোখলেছুর রহমানের স্বজনেরা গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের আদালতে হাজির করার জন্য রিট আবেদন করেন। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ ছাড়া কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। রিটেরও নিষ্পত্তি হয়নি।

ভুয়া র‌্যাব–পুলিশ অপহরণে জড়িত: সরকার

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কেউ গুম হন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততার কথাও তিনি উড়িয়ে দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনও একই দিনে বলেছিলেন, ভূমধ্যসাগরে ডুবে যেতে পারেন নিখোঁজেরা।

তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে সরকার বলেছে, ভুয়া র‌্যাব, ভুয়া পুলিশ অনেক সময় অপহরণে জড়িত থাকে। ২০১৩ সালে জমা দেওয়া সরকারি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময় একটা চল শুরু হয়েছে। অপহরণের যেকোনো ঘটনায় র‌্যাব ও অন্যান্য বাহিনীকে জড়ানো হয়। র‌্যাব এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ভুয়া র‌্যাব ধরেছে, যাদের অনেকে অপহরণের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে সরকার আবারও ভুয়া পুলিশ সদস্যদের কথা উল্লেখ করে।

সরকারের এমন ভাষ্য এবং পুলিশের কাছে গিয়ে বারবার বিফল হয়ে এখন অনেকটাই হতাশ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলো। তাঁদের স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হবে, সে আশা আর তাঁরা করেন না। বসুন্ধরা এলাকা থেকে গুম হওয়া আল আমিনের ভাই রুহুল আমিন আলমারিতে তোলা থাকা কাগজ দেখান, যা এখন অনেকটাই জীর্ণ।

রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ৯ বছরে যতবার ওসি বা তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছেন, তাঁরা একবার করে এসেছেন। আগে আব্বা ছেলে নিখোঁজের কথা বলতেন। এখন তাঁর বয়স হয়েছে, কিছুটা অসংলগ্নও। নিখোঁজের বিবরণ দেওয়ার দায়িত্ব এখন আমার ওপর। জানি না, এরপর আর কতজন এ দায়িত্ব পালন করবেন।’