কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা সৈকতে (সি প্রিন্সেস হোটেলের সামনে) সৃষ্ট একটি গুপ্তখাল
কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা সৈকতে (সি প্রিন্সেস হোটেলের সামনে) সৃষ্ট একটি গুপ্তখাল

গুপ্তখাল চিহ্নিত সৈকতে ঝুঁকি নিয়ে হাজারো পর্যটকের গোসল

ঈদের আমেজ এখনো ফুরায়নি। পর্যটকে ঠাসা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের চার কিলোমিটার এলাকা। এদিকে আন্দামান দ্বীপের কাছে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর। তবু বেসামাল পর্যটকেরা। এদিকে সাগরের তলদেশে (পানির নিচে বালুচরে) যে মরণফাঁদ ‘গুপ্তখাল’ লুকিয়ে আছে, সেদিকে নজর নেই কারও।
সাগরের ঢেউগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে ছয়-সাত ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। গুপ্তখাল চিহ্নিত সৈকতের দুটি পয়েন্টে গোসলে নেমেছেন অন্তত ৩০ হাজার পর্যটক।

গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের এক কিলোমিটারেই জড়ো হয়েছিলেন অন্তত ৫০ হাজার পর্যটক। বালুচরে পা ফেলার জো নেই। সমুদ্রের পানিতেও গিজগিজ অবস্থা। সুগন্ধা পয়েন্টে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের কলাতলী, সিগাল, লাবণী পয়েন্টেও ৪০-৫০ হাজার পর্যটকের সমাগম। পর্যটকেরা কোমরসমান পানিতে নেমে গোসল করছেন। কেউ কেউ টায়ারের টিউবে গা ভাসিয়ে পানিতে ভাসছেন, কেউ দ্রুতগতির নৌযান জেডস্কিতে ছুটছেন গভীর জলরাশির দিকে।  

সি সেফ নামের বেসরকারি লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্টে পর্যন্ত চার কিলোমিটার সৈকতে লাখো পর্যটকের নিরাপত্তায় ২৬ জন লাইফগার্ড ছাড়া অবশিষ্ট ১১৬ কিলোমিটার সৈকতে তেমন কেউ নেই। সম্প্রতি চার কিলোমিটার সৈকতের কয়েকটি পয়েন্টে সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ-ছয়টি গুপ্তখাল। গুপ্তখাল এলাকা চিহ্নিত সৈকতে গোসলে নামছেন লাখো পর্যটক।

বেলা ১১টার দিকে সুগন্ধা সৈকতে গোসলে নেমেছিলেন ঢাকার বংশাল এলাকার ব্যবসায়ী মঞ্জুর আলম। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে। একটি টায়ার টিউবে ভেসে তাঁরা চারজন ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছিলেন। মুহূর্তে বিশাল এক ঢেউয়ের ধাক্কায় স্ত্রী ও এক মেয়ে টিউব থেকে ছিটকে পড়ে গভীর সাগরের দিকে ভেসে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। তখন কারও গায়ে লাইফ জ্যাকেটও ছিল না।

বালুচরে উঠে মঞ্জুর আলম (৫০) বলেন, ‘লাইফ জ্যাকেট ছাড়া টিউবে উত্তাল সমুদ্রে নামা ঠিক হয়নি। টিউবে ভাসলে বোঝা যায় না, সাগরের কত গভীরে চলে এলাম। অল্পের জন্য বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি।’

কক্সবাজার সৈকতে ঝুঁকি নিয়ে গোসলে ব্যস্ত পর্যটকেরা। গতকাল দুপুরে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুগন্ধা পয়েন্টে গোসলে নামা পর্যটকদের উঠে আসার তাগিদ দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন চারজন লাইফগার্ড। দুজন বালুচরে স্থাপিত পৃথক দুটি চৌকিতে দাঁড়িয়ে সাগরে গোসলে নামা পর্যটকদের নজরদারি করছেন।

লাইফগার্ডরা বলেন, উত্তাল সমুদ্রে গোসলের মজা আলাদা। কিন্তু গুপ্তখাল যেকোনো মুহূর্তে বিপদ ডেকে আনতে পারে। সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে সৃষ্টি হয়েছে পাঁচ-ছয়টির বেশি গুপ্তখাল। ভাটার সময় দুয়েকটি গুপ্তখাল দৃশ্যমান হলেও অন্যগুলো চোখে দেখা যায় না।

৪ মে বিকেলে সি প্রিন্সেস হোটেলের সামনের গুপ্তখালে আটকা পড়ে তিনজন কিশোর। এর মধ্যে দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও সাইফুল ইসলাম (১৬) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়।

লাইফগার্ড মো. জহির বলেন, জোয়ারের সময় গুপ্তখালগুলো ডুবে থাকলে পরখ করার উপায় থাকে না। কোমরসমান পানিতে নেমে গোসলের সময় বেখেয়ালে গুপ্তখালে কেউ আটকা পড়লে জীবিত উদ্ধার করা কঠিন।

সি সেফ লাইফগার্ডের তথ্য, গত পাঁচ বছরে চার কিলোমিটারের এই সৈকত থেকে উদ্ধার হয়েছে ৬ জন পর্যটকসহ ২৫ জনের লাশ। ভেসে যাওয়ার সময় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৫২৩ জন পর্যটককে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী।

১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে ঢাকার কলেজছাত্র মিনহাজ উদ্দিন ইয়াছির নামের ২২ বছরের এক তরুণ সৈকতে গোসল করতে নেমে মারা যান। এরপর ইয়াছিরের বাবা শাহাবুদ্দিন সৈকতে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ডানকানের আর্থিক সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘ইয়াছির লাইফগার্ড স্টেশন’। ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে ইয়াছির লাইফগার্ডরা সৈকতের চার কিলোমিটার থেকে ৯৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে পর্যটক ৬২ জন। জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক। ৬২ পর্যটকের মধ্যে একাই ৫০ জনকে উদ্ধার করেছিলেন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডুবুরি ও লাইফগার্ডটির পরিচালক মোস্তফা কামাল।

মোস্তফা কামাল বলেন, অধিকাংশ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে হঠাৎ করে সৃষ্ট গুপ্তখালে আটকা পড়ে। পাতকুয়ার মতো গুপ্তখালে আটকা পড়লে প্রশিক্ষিত ডুবুরিদের ক্ষেত্রেও উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন। গত ৪০ বছরেও সৈকতের চার কিলোমিটারে ডুবুরি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি এনে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে হয়। লাইফগার্ড আর ডুবুরি এক জিনিস নয়।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, লাইফগার্ডদের ডুবুরির প্রশিক্ষণ থাকলেও সাগরের তলদেশে গিয়ে ঘণ্টাখানেক সময় ডুবে থাকার সরঞ্জাম নেই। এখন পর্যন্ত সৈকতে ডুবুরি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়নি।

ট্যুরিস্ট পুলিশ, লাইফগার্ড ও হোটেল মালিকেরা জানান, ঈদের ছুটির গত ছয় দিনে সৈকত ভ্রমণে এসেছেন অন্তত আট লাখ পর্যটক। ১০ মে পর্যন্ত দুই দিনে আরও দুই লাখ পর্যটকের আগমন ঘটবে। সব মিলিয়ে ঈদের টানা সাত দিনের ছুটিতে ১০ লাখের বেশি পর্যটকের ভ্রমণের বিপরীতে হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউসসহ পর্যটন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা হবে ৫০০ কোটি টাকার ওপর।

ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ১২০ কিলোমিটার সৈকতে প্রায় চার কিলোমিটারে (কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল ও লাবণী পয়েন্ট) গোসলের ব্যবস্থা আছে। অবশিষ্ট এবং অরক্ষিত ১১৬ কিলোমিটার সৈকতে উদ্ধারে কেউ নেই। যদিও অরক্ষিত টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, উখিয়ার ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগরসহ কয়েকটি পয়েন্টে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নামছেন।