অন্য বাংলাদেশ

গল্পটা সাফল্যের, অনুপ্রেরণার

নিজের কারখানায় কারিগরদের তৈরি বিস্ত দেখছেন উদ্যোক্তা রায়হান আলী। বগুড়া সদর উপজেলার বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো
নিজের কারখানায় কারিগরদের তৈরি বিস্ত দেখছেন উদ্যোক্তা রায়হান আলী। বগুড়া সদর উপজেলার বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ায়।  ছবি: প্রথম আলো

চার বছর আগেও তাঁরা কেউ ছিলেন বেকার; কেউ রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, বাসে চালকের সহকারী, কেউবা ছিলেন দোকান কর্মচারী। এখন তাঁরা বিশেষ পোশাক তৈরির দক্ষ কারিগর। এই পোশাক তাঁরা হাতে তৈরি করছেন আরব-দুনিয়ার অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য।

এই সাধারণ মানুষদের যিনি বদলে দিয়েছেন, তিনি বগুড়া সদর উপজেলার বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ার মো. রায়হান আলী (৩৬)। তিনিই আরব পুরুষদের জড়োয়া পোশাক বিস্ত আর নারীদের আভায়া তৈরি করাচ্ছেন এঁদেরকে দিয়ে। আর তা রপ্তানি করছেন সৌদি আরব, কাতার ও দুবাইয়ে।

দুই দশক আগে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছিলেন রায়হান। সেখানকার একটি পোশাক কারখানায় পাঁচ বছরে বিস্ত আর আভায়া তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেন তিনি।

পাঁচ বছর পর ২৫ জন শ্রমিক নিয়ে রায়হান নিজেই সৌদি আরবে কারখানা দেন। তাঁর পোশাকের মান দেখে কাতারের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাঁকে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে কাতারে পাড়ি দেন রায়হান। কিন্তু রায়হান চাইলেও সে পোশাকে বাংলাদেশের কোনো নাম থাকত না।

দেশে ফিরে আসেন রায়হান। বগুড়ায় পোশাক তৈরির কারখানা খোলেন। গ্রামের অদক্ষ শ্রমিক, শিক্ষার্থী মিলে অর্ধশত তরুণ-তরুণীকে কাজ শেখান। কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁরা পুরোদস্তুর দক্ষ কারিগর হয়ে ওঠেন। এখন সৌদি আরব, কাতার ও দুবাইয়ে মাসে প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছেন রায়হান। তবে পোশাক তৈরির কাঁচামাল কাপড়, জরি, সুতা ইত্যাদি তিনি আমদানি করছেন বিদেশ থেকে।

রায়হানদের সাত ভাইবোনের বড় পরিবার। এসএসসি পাস করে বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালে চলে যান সৌদি আরবে। বড় দুই ভাই তোতা মিয়া ও নূর আলম আগেই সেখানে ছিলেন। ভাইদের সুবাদে কাজ পান আলী মোহাম্মদ আল গাত্তান নামের একটি পোশাক কারখানায়। সেখানে সৌদির আমির-ওমরাহদের পোশাক তৈরি হতো।

২০০৪ সালে দেশে আসেন রায়হান। সৌদি আরবের আলী মোহাম্মদ আল গাত্তানের কারখানা থেকে পোশাক কিনত কাতারের আল শরাফি ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা রায়হানের সঙ্গে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেয়। রায়হান তাতে সাড়া দেননি। নিজেই সৌদি আরবে একটা পোশাক কারখানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৬ সালে আবার সৌদি আরবে যান এবং ২০ জন বাংলাদেশি ও ভারতীয় কারিগর নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সৌদি সরকার কোনো বাংলাদেশির নামে ব্যবসার লাইসেন্স দেয় না। বাধ্য হয়ে হানি মোহাম্মদ আল মার্শাল নামের এক মালিকের নামে কারখানা চালাতে হতো। বিনিময়ে প্রতি মাসে তাঁকে ১ হাজার ৫০০ রিয়াল করে দিতে হতো। ওই কারখানায় তৈরি পোশাক দাম্মাম, রিয়াদ, জেদ্দাসহ নানা শহরে বিক্রি হতো। পাশাপাশি কাতারের বিস্ত আল সালেম নামের একটি প্রতিষ্ঠানও রায়হানের তৈরি পোশাক কিনত।

রায়হান বলেন, ‘মালিক, কারিগর সব বাংলাদেশি। কিন্তু পোশাকে লিখতে হতো মেড ইন সৌদি অ্যারাবিয়া। বিষয়টা কষ্ট দিত। ২০১১ সালে বড় ভাই তোতা মিয়াকে কারখানা বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। দুই বছর বসেছিলাম। এরই মধ্যে কাতারের আল শরাফি ট্রেডিংয় আবার যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। এবার রাজি হলাম।’

রায়হানের ভাষ্যমতে, শর্ত ছিল কারখানা চালাবেন তিনি। পুঁজি কাতারের প্রতিষ্ঠানের। তৈরি পোশাক কাতারজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির ২৬টি চেইনশপে বিক্রি হবে। লাভের ২০ শতাংশ দেওয়া হবে রায়হানকে। ২০১৩ সালে কাতারে গিয়ে কারখানা খোলেন রায়হান। এখানেও পোশাক বাজারজাত হতো মেড ইন কাতার নামে। ৯ মাস ব্যবসা করার পর লাভের অংশ দিতে টালবাহানা শুরু করে কাতারের প্রতিষ্ঠানটি। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন রায়হান।

২০১৩ সালের শেষ দিকে রায়হান কিছু জমি বিক্রি করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ১৮ লাখ টাকা জোগাড় করেন। কিন্তু কারিগর পাবেন কই? বিস্ত ও আভায়া তৈরিতে আরব দেশের আবহাওয়ার উপযোগী যে বিশেষ ধরনের কাপড় ব্যবহৃত হয়, তা তৈরি করে জাপান। ওই পোশাকে ব্যবহৃত হয় স্বর্ণখচিত জরি। সেই জরি তৈরি করে সৌদি আরব। রায়হান সিদ্ধান্ত নিলেন কাপড় ও জরি সৌদি আরব থেকে আনবেন। বাকি উপকরণ কিনবেন বাংলাদেশ থেকে। বাড়ির পাশে কবুরহাট বাজারে কারখানার জন্য ছয় হাজার টাকায় একটা ঘর ভাড়া নেন। বিভিন্ন পেশার চারজন লোক ডেকে মাসখানেক প্রশিক্ষণ দেন। এরপর ভালো বেতনের কথা শুনে ৭০ জন তরুণ-তরুণী কারখানায় কাজ শিখতে এলেন। পুরোদমে কাজ শুরু হলো। কারখানার নাম দিলেন ‘মমতাজ বিস্ত মহল’। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে নিবন্ধন নিলেন। মাসে ২০০ থেকে ২৫০টি তৈরি পোশাকের চালান সৌদি আরবে পাঠাতে শুরু করলেন। প্রতি মাসে প্রায় ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হতে থাকল। কাতার ও দুবাই থেকেও পোশাকের ফরমাশ আসতে শুরু করল।

সাফল্যই কাল হলো রায়হানের। ঈর্ষান্বিত স্থানীয় কয়েকজন রায়হানের কারখানার পাশে একটি কারখানা দিলেন। বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে তাঁর ৪০ জন কারিগরকে নিয়ে গেলেন। শ্রমিক সংকটে কারখানা বন্ধ হলো রায়হানের। বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াল। ছয় মাস পর আবার সৌদি আরবে পাড়ি দিলেন রায়হান। সেখানে মাস তিনেক থেকে গত বছর দেশে ফিরে ২০ জন পুরোনো কারিগর নিয়ে কারখানা চালু করলেন। বাড়ির পাশে বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ায় আরেকটি কারখানা দিলেন। বাজার না পাওয়ায় কয়েক মাসের মাথায় বন্ধ হয়ে যায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারখানাটি।

বানদীঘি হাপুনিয়াপাড়ায় রায়হানের মমতাজ বিস্ত মহলে গিয়ে দেখা গেল সরগরম পরিবেশ। ১৮ জন কারিগর কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা ধাপে কাজ করতে হয় তাঁদের। প্রতিটি ধাপের জন্য মজুরি পান ৭০০ টাকা। পোশাকের ডিজাইনার ও কাটার মাস্টার রায়হান নিজেই।

কারিগর মিনহাজ প্রামানিক বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স শেষ বর্ষে পড়েন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে সম্মান শ্রেণিতে পড়ার সময় টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন মাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলছে।

কারিগর রাহি ইসলাম সরকারি আজিজুল হক কলেজে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্সে পড়ছেন। কারখানার ব্যবস্থাপক জোবায়ের ইসলামও একই কলেজে পড়ছেন। আজিজুল ইসলাম রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন। রায়হানের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন তিনি মাসে ১৪ হাজার টাকা আয় করছেন। সুমন সরদার কাজ করতেন ওয়ার্কশপে। দিনে ২০০ টাকা পেতেন। ২০১৪ সালে এখানে কাজ শেখেন। এখন মাসে ১২ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।

রাজমিস্ত্রি আজাহার আলীর মেয়ে আতিকা সুলতানা আলিম পাস। বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে মাসে দেড় হাজার টাকা উপার্জন হতো। এখন এই কারখানায় কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা পাচ্ছেন।

রায়হান বলেন, তাঁর কারখানায় চার ধরনের পোশাক তৈরি হচ্ছে। আমির-ওমরাহদের জন্য ৫ দশমিক ৫ ক্যারেট স্বর্ণখচিত জরির বিস্ত, অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য দুবাইয়ের জরি দিয়ে তৈরি দুবাই বিস্ত, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের জন্য ভারতীয় জরি দিয়ে তৈরি বিস্ত। বোরকার আদলে নারীদের জন্য তৈরি হয় আভায়া।

রায়হান জানান, শুরুতে মাসে গড়ে ৮০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হতো। এখন কারিগর ও পুঁজি সংকটে মাসে গড়ে ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের পোশাক পাঠাতে পারেন। সেই হিসাবে বছরে ছয় লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হচ্ছে রায়হানের কারখানা থেকে। তবে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় অনেক বেশি বলে কারখানা চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

রায়হান বলেন, ‘মাসে চাহিদা থাকে দুই হাজার পোশাকের। এর মাত্র ২০ শতাংশ পাঠাতে পারছি।’

বগুড়া জেলা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মাছুদুর রহমান বললেন, রায়হান রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি মেড ইন বাংলাদেশ লেখা এই পোশাককে বিশ্ববাজারে পাঠিয়ে বাংলাদেশের সুনাম বাড়াচ্ছে।’