বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠতেই মন খারাপ হয়ে যায় কৃষক আবুল হোসেনের। রাস্তায় ওঠার সময় গোয়ালঘরের দিকে চোখ যায়, মনে পড়ে যায় গাভি আর বাছুরটির কথা। বাদামি রঙের গাভিটির বাছুরটিও হয়েছিল বাদামি। তবে ধান কাটার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল তাঁর। উপায় না দেখে বেচে দিতে হয়েছে পশু দুটিকে।
আবুল হোসেনের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ত্রিমোহন গ্রামে। এ বছর চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন তিনি। সবই তাঁর নিজের জমি। জমিতে সার-কীটনাশক দেওয়া, সবই ঠিকঠাকভাবে করেছেন। মোট উৎপাদন খরচ শ্রমিকদের ধান কাটার খরচ ধরে হবে ৬৪ হাজার টাকা। আশা করেছিলেন, ধানের ভালো দাম পাবেন। কিন্তু ধানের যা দাম তাতে হতাশ আবুল হোসেন। পার বিঘায় ১৬ মণ করে ধান হবে বলে মনে করছেন তিনি। মণ প্রতি ৫০০ টাকায় ধান বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা পাবেন । সেই হিসেবে উৎপাদন খরচই উঠছে না তাঁর।
আবুল হোসেনের মাঠের ধানে পাক ধরেছে। আশপাশের সবাই ধান কাটা শুরু করেছেন। তিনি কাটেন না। মনের ভেতর দুশ্চিন্তার ঝড় বয়ে যায় তাঁর। চার বিঘা জমির ধান কাটতে কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার দরকার। রোজ একজন শ্রমিকের মজুরি আটশো টাকা।
আবুলের হাতে কোনো টাকা ছিল না। রাত-দিন ভাবছিলেন, কীভাবে তিনি টাকা জোগাড় করবেন? একবার ভাবেন, সুদে টাকা নেবেন। আবার ভাবেন, ধানের দাম ভবিষ্যতে যে বাড়বে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আবুল হোসেন তাঁর স্ত্রী উজালা বেগমের সঙ্গে পরামর্শ করেন। অনেক ভেবে উজালা বেগম গাভি বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, গাভি বিক্রির টাকায় ধান কাটা হয়ে যাবে। সুদের টাকার অনেক জ্বালা। সুদের টাকা নেওয়ার দরকার নেই।’
সব ভেবে চিনতে গাভি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন আবুল। গাভির সঙ্গে বাছুরও আছে। তাই বিক্রি করলে গাভি-বাছুর একই সঙ্গে বিক্রি করতে হবে। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেন তিনি। ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যায় তাঁর সাধের বাদামি গরু আর বাছুর। ব্যাপারী যখন গাভি আর বাছুর গোয়ালঘর থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কেঁদে ফেলেছিলেন আবুল।
গাভি বিক্রির সেই টাকা হাতে পাওয়ার পর আবুল হোসেন মির্জাপুরের হাটে গিয়ে দশ জন শ্রমিক (স্থানীয় ভাষায় কামলা) নিয়ে আসেন বাড়িতে। প্রতিদিন আটশো টাকার পাশাপাশি তিন বেলা খাওয়াতে হয় এক একজন শ্রমিককে। আবুল হোসেনের ধান কাটা চলছে। দুই বিঘার মতো কাটা হয়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে কথা হয় আবুল হোসেনের সঙ্গে। স্ত্রীকে নিয়ে ত্রিমোহন মাঠে ধান মাড়াই করছিলেন। গনগনে রোদে অস্থির হয়ে ছিলেন এই দম্পতি। একমুঠো ধান হাতে নিয়ে আবুল হোসেন বলেন, কীটনাশক দেওয়ার পরও ধান পোকায় ধরেছিল। ধানে চিটার পরিমাণ বেশি।’
ধানের ওপর গিয়েই যেন আবুল হোসেনের সব রাগ পড়েছে। প্রথম আলোকে বললেন, 'ধানের আবাদ আর করুম না। লাভ তো হয়ই না। সব লোকসান। ধান বুনে গরু-বাছুর ব্যাচন লাগে। খাওন লাগে, তা ই পেটের দায়ে আবাদ করি। ' মাঠ থেকে আবুল হোসেন যান নিজের বাড়িতে। গোয়ালঘরের কাছে গিয়ে বলেন, ধানের আবাদ করে গাভি-বাছুর হারাতে হয়েছে। রোজ দুই সের করে দুধ দিত।
ধান চাষ কেন করেছেন জানতে চাইলে আবুল জানান, বাপ দাদারা ধান চাষ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনিও ধান চাষ করছেন। এই পেশায় বড় মায়া তাঁদের। তবে এখন বড় দুশ্চিন্তা হয়। বলেন, ‘ধান আবাদ করে আর কত লস দিমু। আর কত জিনিস খোয়ামু।'
উজালা বেগম বললেন, ধানের দাম থাকলে তো আর গাভি বেচতে হতো না।