শহরের বেশির ভাগ মানুষের আস্ত গরু কেনার অভিজ্ঞতা হয় সাধারণত বছরে একবারই। ঈদুল আজহার সময়। এর বাইরে বছরজুড়ে মাংসের জন্য কসাইয়ের দোকানে রডে গেঁথে রাখা মাংসের চাকা বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দোকানে কাচের বাক্সে খণ্ড খণ্ড করে রাখা মাংসের ওপরই নির্ভর করতে হয়। শহুরে জীবনের এ অভ্যস্থতায় ঈদুল আজহার সময় গরু কিনতে গিয়ে অনেক আনাড়ি ও শৌখিন ক্রেতাই কোন গরু ভালো, কোন গরুতে মাংস কতটুকু হবে, এ নিয়ে ধন্দে পড়ে যান।
এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ঈদুল আজহাকে ঘিরে গরু কেনাবেচার স্বাভাবিক চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সরকার হাটের সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। ফলে দুই–তিন বছর ধরে অনলাইনে গরু কেনার যে ধারা শুরু হয়েছে, এবার তা ব্যাপকতা পেয়েছে। হাটের চেয়ে অনলাইনে গরু কেনার নির্ভরতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে গরু ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তৈরি অ্যাপের কদর।অন্য সময়ের তুলনায় জুলাই মাসে বিএলআরআই ফিডমাস্টার নামের অ্যাপটি গুগুল প্লে স্টোর থেকে দ্বিগুণসংখ্যক ডাউনলোড হয়েছে। কারণ অ্যাপটির কয়েকটি অপশনের মধ্যে একটি অপশনের মাধ্যমে গরুর সম্ভাব্য ওজন ও মাংসের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশে অ্যাপটি ব্যবহার হচ্ছে। পাইলট পর্যায়ে বাস্তবায়ন শেষে অ্যাপটি জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গত ৭ জুন।
বিএলআরআই জানিয়েছে, অ্যাপে রেশন, বাসস্থান, ওজন, টিকার এলার্ম, বই, উদ্ভাবক পরিচিতি, জরুরি যোগাযোগ ও মন্তব্যের অপশন রাখা আছে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। ফিতা দিয়ে বুকের মাপ, দৈর্ঘ্য (ইঞ্চি) লিখে মোট ওজন ও মাংসের পরিমাণ বের করা যায়। দৈর্ঘ্য মাপার ক্ষেত্রে কোন পয়েন্ট থেকে কোন পয়েন্ট পর্যন্ত মাপ দিতে হবে, তা অ্যাপে ছবি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাভারে অবস্থিত বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক নাথু রাম সরকার বলেন, গরুর ওজন ও মাংসের ধারণা পেতে ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে। সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গরুর বয়স, লিঙ্গ ও উৎপাদনসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে অ্যাপটি তৈরি করেছেন বিএলআরআইয়ের বৈজ্ঞানিকেরা। এটি মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত তথ্যটি জানিয়ে দিচ্ছে। ওজন ও মাংসের পরিমাণ জানার ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ যথাযথ তথ্য দেয় অ্যাপটি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গরুর ওজন মাপের ম্যানুয়াল পদ্ধতিটি হচ্ছে (গরুর বুকের বেড়2 xদৈর্ঘ্য)/৬৬০। বুকের বেড় এর বর্গমূল ও দৈর্ঘ্য ইঞ্চিতে নিতে হবে।
অ্যাপটির উদ্ভাবক বিএলআরআইয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আহসানুল কবির জানান, গরুকে যথাযথ পরিমাণের খাবার খাইয়ে স্বাস্থ্যকরভাবে লালনপালনের উদ্দেশ্যে খামারিদের জন্য মূলত অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। এখন এটি ব্যবহার করছে ১৮ হাজার ব্যবহারকারী। তিনি জানান, গত মাসে অ্যাপটি ৮৩০ জন ডাউনলোড করেছেন গুগলের প্লে স্টোর থেকে। এ মাসে এটা বেড়ে ২ হাজার ৩৮০ জন হয়েছে। অন্য মাসগুলোয় এটার ডাউলোড এক হাজারের নিচে থাকে। ২০ জুলাই থেকে এটি ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এটা ঈদুল আজহার কারণে বলে তিনি মনে করছেন।
আহসানুল কবির জানান, অ্যাপটির মাধ্যমে গরুর চামড়া ও নাড়িভুঁড়ি বাদ দিয়ে ওজন আসে। তিনি জানান, গরুর যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য ফিডমাস্টার নামে এই অফলাইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করা হয় ২০১৬ সালে। প্রথমে শুধু সাভারে এটি পাইলটিং পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়। পরে সাভারের মুশুরীখোলা, রাজশাহীর রাজাবাড়ি হাট ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে প্রয়োগ করা হয়। এ বছর থেকে এটি সারা দেশে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
শাহজালালর ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিন ইমদাদ বিএলআরআই ফিডমাস্টার অ্যাপটি ব্যবহারের কথা জানালেন। তিনি ঈদুল আজহা উপলক্ষে এবার হাম্বা–হাম্বা ডটলাইন নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে অনলাইনে একটি গরু কিনেছেন। তিনি ফিডমাস্টার অ্যাপে তাঁর কেনা গরুটির বুকের মাপ ৬০ ইঞ্চি ও নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য ৪৩ ইঞ্চি লেখার পর মোট ওজন দেখিয়েছে ২৩৪ দশমিক ৫৫ কেজি। এতে ৫৫ শতাংশ হিসাবে মাংসের সম্ভাব্য পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১২৯ থেকে ১৪০ দশমিক ৭৩ কেজির মধ্যে। তিনি বলেন, অ্যাপটি সম্পর্কে তেমন কোনো প্রচার নেই। কোরবানির গরু কেনার আগে এ অ্যাপটি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রেতারা ওজন নেওয়াসহ মাংসের সম্ভাব্য পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবেন।
গরু খামারি হাম্বা–হাম্বা ডটকমের স্বত্বাধিকারী আর কে হান্নান বলেন, তাঁরা অনলাইনে গরুর ওজন–ছবি দিয়ে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ক্রেতাদের যাচাই করার সুবিধার্থে ওয়েবসাইটে ফিডমাস্টার অ্যাপটি সংযুক্ত করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরও আমরা কোরবানির গরু বিক্রির সময় অ্যাপটি সংযুক্ত করে দিয়েছিলাম। তবে এবার এটার ব্যবহার বেশি মনে হচ্ছে। এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনেকেই হাটে না গিয়ে অনলাইনের ওপর নির্ভর করছেন। এ কারণেও অ্যাপটির ব্যবহার বাড়তে পারে। আমরাও নিজেদের খামারে গরু পালনের জন্য অ্যাপটি ব্যবহার করে থাকি।’
তিনি জানান, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা গ্রামে দুই একর জমির ওপর তাঁর খামার রয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে অনলাইনে কোরবানির গরু বিক্রি শুরু করেছেন। বিক্রি আশাব্যঞ্জক।
বিএলআরআই উদ্ভাবিত অ্যাপটি বাংলাদেশ ছাড়াও ব্যবহার হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়।
অ্যাপটি তৈরির উদ্দেশ্য
সঠিক পরিকল্পনা, খাদ্য ও খামার ব্যবস্থাপনা ও তথ্যের অভাবে গরুর খাদ্যচাহিদা নিরূপণ ও ঠিক সময়ে টিকা দিতে না পারায় দুধ ও মাংসের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে খামারিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁরা খামার করতে উৎসাহ বোধ করেন না।
ফিডমাস্টারে গরুর বয়স, লিঙ্গ ও উৎপাদন অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বুকের মাপ ও দৈর্ঘ্য অথবা ওজন সাপেক্ষে ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের (এনআরসি) ফিডিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে অল্প সময়ে অল্প খরচে গরুর জন্য সুষম রেশন তৈরি করতে পারে। এতে খামারিরা ঘরে বসেই সহজে বাজারে প্রাপ্ত মিক্সফিডের তুলনায় কম খরচে সুষম রেশন তৈরি করতে পারেন। সেই সঙ্গে অ্যাপটি প্রাণীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সবুজ ঘাসের পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি খামারিদের মাসিক ও বার্ষিক ঘাস উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বাসস্থান তৈরির মডেল সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। ওজন স্কেল ছাড়া ওজন নির্ণয় করতে পারে। খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে খামারে রোগ প্রবেশের আগে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম ও খুদে বার্তার মাধ্যমে টিকা ও কৃমিনাশক দেওয়ার জন্য খামারিদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
এ ছাড়া অ্যাপ্লিকেশনটি বিএলএরআই উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তি ও প্রাণী পালনের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা–সম্পর্কিত তথ্য ই–বুক আকারে খামারিদের কাছে পৌঁছাতে পারে। এতে বিএলআরআইয়ের বিজ্ঞানীদের ফোন নম্বর ও ই–মেইল ঠিকানা থাকায় খামারিরা সহজে যোগযোগ করতে পারেন।