গরিবের জমির ক্ষতিপূরণের টাকা মিলেমিশে ভাগাভাগি

এসপিএম প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে বরাদ্দ ৫২ কোটি টাকার বড় অংশটি আত্মসাতের অভিযোগ। ৯৬ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে একটি ভাসমান তেলের ডিপো ও তেল রাখার স্থাপনা নির্মাণের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নামে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। ওই প্রকল্পের জন্য ১৯১ একর পাহাড়ি বনভূমি অধিগ্রহণ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তিন বছরের জন্য হুকুমদখলে নেওয়া হয় ১৪৪ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। ওই জমির মালিক ও ভোগদখলকারীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার মোট ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ভূমিমালিকদের অনেকে এ টাকা পাননি। একটি চক্র ভুয়া মালিক বানিয়ে এ টাকার বড় একটি অংশ তছরুপ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। গত ৩০ জুন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন শরীফ উদ্দিন। ওই প্রকল্পের দুর্নীতির সঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজার-২ আসনের (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, প্রকল্প এলাকা কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান (শরীফ) এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনসহ মোট ৯৬ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে এসেছে। তাঁরা গরিব ভূমিমালিকদের ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শতভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুদক থেকে ওই প্রতিবেদন বিষয়ে গত জানুয়ারিতে আরও বিস্তারিতভাবে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। নতুন একজনকে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আমরা যখন প্রকৃতি রক্ষার কথা বলি, তখন দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতির সুযোগ কমে যাওয়া হিসেবে দেখে। একমাত্র শক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই পারে দুর্নীতি বন্ধ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করতে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

কক্সবাজারে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি এসপিএম নামের প্রকল্প। তিনটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির তদন্ত করেন শরীফ উদ্দিন।

এসপিএম প্রকল্পটি মূলত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন (সিপিপি) ব্যুরো। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের উপকরণ সরবরাহের ব্যবসা দেওয়া থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার কাজও করেছে, যা মূলত কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি শাখার দায়িত্ব।

এসপিএম প্রকল্পের পরিচালক হাসনাত শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে জমি বুঝে নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছি। ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা বণ্টনের দায়িত্ব আমরা পালন করি না।’ দুদকের প্রতিবেদনে দুর্নীতিপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছিল, আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তার জবাব দিয়েছি।’

বনের গাছের টাকা আত্মসাৎ

এসপিএম প্রকল্পের জন্য মহেশখালীতে মোট ১৯১ একর পাহাড়ি বনের জমি অধিগ্রহণ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। সেখানে জনবসতি ও মানুষের কৃষিকাজ চলত। এ জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোট ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই জমিতে সামাজিক বনায়নের আওতায় থাকা ২৭ হাজার গাছ কেটে পরিষ্কার করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

দুদকের তদন্তে বলা হয়, চীনা কোম্পানির পক্ষে শ্রমিকেরা ওই গাছ কাটতে গেলে স্থানীয় লোকজন এবং কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান বাধা দেন। চীনা কোম্পানি সিপিপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দর-কষাকষির পর তা কাটার দায়িত্ব দেয় শাহাদাত নামের এক ঠিকাদারকে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই গাছ কাটা বাবদ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা অর্থের ৪০ শতাংশ গাছের মালিকদের দিয়ে বাকি টাকা চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান ও শাহাদাত আত্মসাৎ করেন।

এ ব্যাপারে তারেক বিন ওসমানের কাছে এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কেটে দেন।

চীনা কোম্পানি সিপিপির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের কাজে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা পেলেও স্থানীয়ভাবে তাঁদের অনেক বিষয় সামলাতে হচ্ছে।

ক্ষতিপূরণের ২২ কোটি টাকা ক্ষমতাধরদের পকেটে

চীনা কোম্পানি সিপিপির কার্যালয় স্থাপন ও নির্মাণ উপকরণ রাখার জন্য কালারমারছড়া ইউনিয়নের ১৪৪ একর কৃষিজমি তিন বছরের জন্য হুকুমদখল (অধিযাচন) করা হয়। এর শর্তে বলা হয়, ওই জমিতে উৎপাদিত ফসলের সমপরিমাণ অর্থ প্রতিবছর জমির মালিকদের দেওয়া হবে। এ জন্য প্রতিবছর মোট ২২ কোটি টাকা ধার্য করা হয়।

ওই জমির মালিকদের নামে ২০১৭-১৮ সালে হুকুমদখলের নোটিশ জারি করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই নোটিশ গোপন করে প্রকৃত মালিকদের অন্ধকারে রাখা হয়। একদল ভুয়া মালিক হাজির করিয়ে তাঁদের নামে চেক ইস্যু করা হয়। তাঁরা ২০১৮ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ওই ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়ে যান। কিছু টাকা নিজেরা রেখে বাকি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ওই চক্রের হাতে তুলে দেন। ওই খবর পেয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিকেরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও এবং মানববন্ধন করেন। পরের দুই বছর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নামে আর কোনো টাকা বরাদ্দ হয়নি।

কক্সবাজারের সামাজিক আন্দোলনের নেতা ও মহেশখালীর অধিবাসী এ কে এম কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তদন্ত কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। এর ফলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসা দুর্নীতির শাস্তি ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে গেল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা আছে।

চেয়ারম্যান আর মামুদের রাজত্ব

দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প এলাকায় কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান ও তাঁর ভাই আইনজীবী নোমান শরীফ প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। তাঁরা স্থানীয় একটি দালাল চক্র তৈরি করে ভূমিমালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করে দেওয়া বাবদ ক্ষতিপূরণের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ দাবি করেন। স্থানীয় লোকজন দালাল চক্রের অর্থ দাবির বিষয়টি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান এবং কুতুবজোম ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনকে (খোকন) জানান। কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এলাকাবাসী স্থানীয় সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিকের কাছে যান।

চীনা কোম্পানি সিপিপি আগে থেকেই মেসার্স এহসান এন্টারপ্রাইজ নামের একটি কোম্পানিকে ওই এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিমালিক, গাছ, ফসল ও লবণচাষিদের হিসাব তৈরির দায়িত্ব দেয়। এহসান এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. এহসান কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমানের মামা। প্রতিষ্ঠানটিকে চীনা কোম্পানি থেকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের ২২ কোটি টাকা হস্তান্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা ওই টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের না দিয়ে ভুয়া মালিক তৈরি করে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠায়। পরে তা দুই চেয়ারম্যান, নোমান শরীফ এবং মো. এহসান ভাগাভাগি করে নেন। প্রকৃত ভূমিমালিকেরা ক্ষতিপূরণ না পেয়ে সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিকের কাছে আবার অভিযোগ করেন।

একাধিক প্রক্রিয়া শেষ করে, কাগজপত্র যাচাই করে ক্ষতিপূরণের টাকা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে দেওয়ার কথা। কিন্তু কাজটি করে চীনা কোম্পানি। তারা আবার দায়িত্ব দেয় এহসান এন্টারপ্রাইজকে। এসব প্রশ্ন তুলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনা কোম্পানি স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে এ ধরনের অবৈধ কাজে যুক্ত হয়েছে। তাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সহযোগিতা করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, সাংসদ রফিক তখন বিষয়টি নিয়ে চীনা কোম্পানি সিপিপি, আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা এবং দুই চেয়ারম্যান ও নোমান শরীফের সঙ্গে আলোচনা করেন। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে দি কক্সটুডে হোটেলে ওই আলোচনা হয়। কিন্তু তাঁরা সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমানের ভাই নোমান শরীফকেই বিষয়টি মীমাংসার দায়িত্ব দেন। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অর্থ আত্মসাৎকারীদের এক অংশ অপর অংশকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেয়।

সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি সরকারি কাজে ভারতে আছেন উল্লেখ করে বলেন, এলাকায় কোনো সমস্যা হলে সাংসদ হিসেবে সমাধান করা তাঁর দায়িত্ব। তবে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এসব বিষয়কে দুর্নীতির সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করছে। এটা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ।

তদন্তে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে চীনা কোম্পানিকে চারটি গাড়ি সরবরাহ করার ঠিকাদারি পান চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমানের মামাতো ভাই মাঈনুল শরীফ ও মর্তুজা আলী। ২০২০ সালে চীনা কোম্পানি ওই প্রকল্পে যত গাড়ি কেনে, তার সবই সরবরাহ করেন চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান। তারেক বিন ওসমান চেয়ারম্যান হওয়ার আগে সিআইএলই ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারী ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি চীনা কোম্পানি সিপিপির ঠিকাদারির কাজ করে থাকে।

মহেশখালীতে জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়নের নামে যে অবকাঠামোগুলো হচ্ছে, তা যে আসলে দুর্নীতির মহাপরিকল্পনা, সেটা শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হলো। ফলে আমরা যখন প্রকৃতি রক্ষার কথা বলি, তখন দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতির সুযোগ কমে যাওয়া হিসেবে দেখে। একমাত্র শক্ত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই পারে দুর্নীতি বন্ধ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করতে।’