গরিবের অন্য রকম গোশত সমিতি

গরুর মাংস কাটা হচ্ছে। ছবি: লেখক
গরুর মাংস কাটা হচ্ছে। ছবি: লেখক

পেশাজীবী সমিতি। সাংবাদিক সমিতি। ট্রাক মালিক সমিতি। শিক্ষক সমিতি। দোকান মালিক সমিতি। আরও কত সমিতি। বাংলাদেশে সব পেশারই একটা-দুটো করে সমিতি রয়েছে। তবে অন্য রকম এক সমিতির খোঁজ মিলেছে। এ সমিতির কথা শুনে যে কেউ অবাক বনে যাবে। যাঁরা কখনো শোনেননি, তাঁদের কাছে অদ্ভুত মনে হবে বৈকি। যে সমিতির খোঁজ মিলেছে, সে সমিতির নাম ‘গরিবের গোশত সমিতি’। 

শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তো। আসলে ছানাবড়া হওয়ারই কথা। এ সমিতির নিয়মকানুনও অদ্ভুত। ঈদুল ফিতরের ঈদ ঘিরে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এ রকম ৭০টি সমিতি গড়ে উঠেছে। ‘গরিবের গোশত সমিতি’ এখন ব্যাপক সাড়া পেয়েছে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের খামারপাড়া এলাকার তরুণ ফয়সাল মিয়া ২০১৭ সালে প্রথমে এ উদ্যোগ নেন। মোট ২৫ জন সদস্য নিয়ে তাঁদের গোশত সমিতির যাত্রা শুরু হয়। চাঁদা গুনতে হয় সপ্তাহে এক শ টাকা। বছরে জমা হয় ৫ হাজার ২০০ টাকা। বিনিময়ে ঈদুল ফিতরের আগের দিন গোশত মেলে ১২ কেজি। এরপর থেকে এলাকায় একে একে গড়ে উঠতে থাকে গরিবের গোশত সমিতি। খোদ খামারপাড়া এলাকায় বর্তমানে ৬টি সমিতি রয়েছে। এ ছাড়া নগরপাড়া, দেইলপাড়া, কামশাইর, বরুণা, বরালুসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ সমিতি গড়ে উঠেছে।

সবার উপস্থিতিতে মাংস কেটে বণ্টন করা হয়। ছবি: লেখক

জানা গেছে, উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ৭০টি সমিতি ঈদের সময় গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের গোশতের চাহিদা পূরণ করছে। সারা বছর একটু একটু করে সঞ্চয় করে ঈদের আগে পশু কিনে জবাই করে মাংস ভাগ করে নেন মাংস সমিতির সদস্যরা। এতে করে ঈদে গরিব পরিবারগুলো বাড়তি আনন্দ পায় এবং তাদের আর্থিক চাপও কমে যায়।


নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গ্রাম, পাড়া বা মহল্লায় ঈদুল ফিতর সামনে রেখে এ ধরনের মাংস বা গরুর মাংসের সমিতি গঠন করা হয়। মাংস সমিতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রতিবছর বাড়ছে মাংস সমিতির সংখ্যা। প্রতিটি মাংস সমিতির সদস্যসংখ্যা ৪০ থেকে ৬০ জন। প্রত্যেক সদস্য সপ্তাহে ১০০ টাকা চাঁদা জমা দেন। ঈদুল ফিতরের দুই বা এক দিন আগে জমা করা টাকায় গরু কিনে এনে জবাই করে সদস্যরা মাংস ভাগ করে নেন। তবে চামড়া বিক্রির টাকায় পরের বছরের জন্য তহবিল গঠন করে সমিতির কার্যক্রম চলে।


সরেজমিনে জানা গেছে, খামারপাড়া এলাকার সমিতির খবর ছড়িয়ে পড়লে গত তিন বছরে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠে গোশত সমিতি। এ সমিতি এখন গরিবের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। সপ্তাহে এক শ টাকা সঞ্চয় হওয়ায় কারও তেমন সমস্যা হয় না।
কথা হয় সমিতির সদস্য খামারপাড়া গ্রামের সফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ঈদে পোলাপানগো কাপড়চোপড় কিনা টেকা শেষ অইয়া যায়। কোনোমতে তেল-সেমাই কিনি। আবার গোশত কিনুম কেমনে? যহন জানলাম সমিতি অইছে, তহন থেইক্যা সমিতিতে নাম লেহাই। অহন ঈদের আগে ১০-১২ কেজি গোশত পামু।’


একই গ্রামের ফজলু হোসেন, মারতুজা ও আমির হোসেন বলেন, ‘এ সমিতি হওয়ায় গরিব মাইনসের (মানুষ) জন্য ভালা অইছে। সপ্তাহে ১০০ টাকা দিতে কষ্ট অয় না। ঈদ আইলে বাড়তি চিন্তা থাহে না।’
সাতারকুল এলাকার নাসরীন সুলতানা। তিনিও রূপগঞ্জের খামারপাড়ায় গোশত সমিতিতে নাম লিখিয়েছেন। তিনি তাঁর ছোট বোন রায়হানা সুলতানার মুখে এ সমিতির গল্প শুনেছেন। তাই এ বছর প্রথম নাম লিখিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালো তো। সপ্তাহে ১০০ টাকা দিতে তেমন কষ্ট হয় না। বছর শেষে একসঙ্গে ১২ কেজি মাংস অনেক উপকার মেলে।


নগরপাড়া এলাকার জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। ঈদ আইলে মাংস কিনবার টেকা থাহে না। তাই সমিতিতে নাম দিছি। ঈদের আগে মাংস পাই ১০ থেকে ১২ কেজি। সারা দিন ভ্যান চালিয়ে সংসারের ঘানি টানি। তার ওপর দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচা।’ ঈদ এলে সবার কাপড়চোপড় কেনা আর তেল-সেমাই-চিনি কিনতে গিয়ে হিমশিম খান তিনি। আদরের সন্তানদের বায়না থাকে ঈদের দিনে গোশত খাওয়ার জন্য। কিন্তু দিনমজুর বাবার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। গত ঈদুল ফিতরে সন্তানের বায়না পূরণ করতে না পেরে এবার নগরপাড়া এলাকার দিনমজুর বাবু গোশত সমিতির সদস্য হয়েছেন। শুধু দিনমজুর বাবু নন, রূপগঞ্জের শত শত পরিবার এখন গোশত সমিতির সদস্য।

এখন মাংস চলে যাবে সদস্যদের ঘরে ঘরে। ছবি: লেখক

মূল উদ্যোক্তা ফয়সাল আহমেদ জানান, প্রথমে তাঁদের সমিতিতে সদস্যসংখ্যা ছিল ২৫ জন। প্রত্যেকে সপ্তাহে টাকা জমা দিতেন। বছর ঘুরে সমিতিতে জমা হয় ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে গরু কিনে এনে সমিতির সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের ভাগে পাঁচ কেজি করে মাংস পড়েছে। তাঁদের এলাকাতেই এ ধরনের অন্তত ছয়টি সমিতি রয়েছে। উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে এই গোশত সমিতি। শবে কদরের দিন থেকে শুরু হয় সমিতির গরু জবাইয়ের কাজ। চলে ঈদের দিন পর্যন্ত।
কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুম আহম্মেদ বলেন, গরিবের গোশত সমিতি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিন দিন এ সমিতির সংখ্যা বাড়ছে। সমিতির কারণে ঈদুল ফিতরে এখন ঘরে ঘরে গরুর গোশত থাকে।