গণপরিবহনে প্রতিবন্ধী নারীর আরেক লড়াই

প্রতিবন্ধী নারীকেই গণপরিবহনে প্রতিদিন নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাঁদের লড়াই করতে হয় বাসে জায়গা পেতে। বাসে তাঁদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তাঁদের কপালে তা জোটে না।

বাসে নারী ও প্রতিবন্ধীদের আসন পুরুষের দখলে থাকে


ঢাকার শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা সামনে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সামনের জায়গাটি টেকনিক্যাল মোড় নামে পরিচিত। সন্ধ্যার দিকে সেখানে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩০ বছর বয়সী এক নারী। তাঁর গন্তব্য সাভার। অন্তত ১০টি বাসকে হাত দেখিয়ে ওঠার চেষ্টা করার পর একটি বাসে জায়গা হয় তাঁর। তা–ও দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর। আগের বাসগুলো অন্য যাত্রী তুললেও তাঁকে নেয়নি। কারণ, এই নারী দুটি ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিবন্ধী এই নারীকে সেদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত একই জায়গায় অপেক্ষা করতে হয়।

ওই নারীর নাম নাসিমা খাতুন। চার বছর বয়সে পোলিও হওয়ার পর থেকে ডান পা একেবারে অচল। হাতে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হয়। সাভার সিআরপি এলাকা থেকে প্রতিদিন মিরপুরে কর্মস্থলে আসেন নাসিমা। প্রথমে বাসা থেকে রিকশা, এরপর বাসে মিরপুর-৬ নম্বর নামেন। সেখান থেকে আবার রিকশায় পৌঁছান কর্মস্থলে। একইভাবে ফেরেন সাভারে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা তাঁকে প্রতিদিন গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়।

অনেক বাসে উঠলেই চোখে পড়বে ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’। কিন্তু যাঁরা প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন, প্রকৃত চিত্রটি তাঁরা ভালোই জানেন।

নাসিমার মতো অনেক প্রতিবন্ধী নারীকেই গণপরিবহনে প্রতিদিন নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাঁদের লড়াই করতে হয় বাসে জায়গা পেতে। বাসে তাঁদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তাঁদের কপালে তা জোটে না। পরিস্থিতি কখনো কখনো লাঞ্ছনার পর্যায়েও চলে যায়। সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জে বাক্‌প্রতিবন্ধী এক নারীকে বাস থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গাড়িচালকের নির্দেশে তাঁর সহকারী ওই নারীকে বাস থেকে ‘ছুড়ে’ ফেলেছিলেন। সেই ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কেরানীগঞ্জে বাস থেকে প্রতিবন্ধী নারীকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় এ প্রশ্ন আবারও সবার সামনে এসেছে, গণপরিবহন–ব্যবস্থা প্রতিবন্ধী নারীর জন্য আসলে কতটা সহায়ক?

অনেক বাসে উঠলেই চোখে পড়বে ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’। কিন্তু যাঁরা প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন, প্রকৃত চিত্রটি তাঁরা ভালোই জানেন। সম্প্রতি ফার্মগেট থেকে আবদুল্লাহপুরগামী একটি বাসে উঠে দেখা গেল, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতে পুরুষেরা বসে আছেন। বাসের অনেক আসন তখনো ফাঁকা। মিরপুর রুটের দুটি বাসে উঠেও একই চিত্র চোখে পড়ে। ফার্মগেট থেকে মিরপুরগামী বিহঙ্গ পরিবহনের এক নারী যাত্রী বলেন, যেকোনো রুটের বাসেই ভিড়ের মাঝে নারীকে সিট আদায় করে নিতে হয় অনেকটা যুদ্ধ করে।

বাসের সামনের সিটেও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় যাত্রীদের

পাশে বসা আরেক নারী যাত্রী নিজেই বলে উঠলেন, ‘সংরক্ষিত আসনগুলোতে বসে থাকে, মহিলা উঠলেও সিট ছাড়ে না। কিন্তু আবার আমরা যদি সিট না পেয়ে নয়টি আসনের বাইরে কোনো আসনে বসি, তাহলে অনেক কথা শুনতে হয়।’
তাদের কথা শুনে যাত্রীদের মধ্য থেকে একসঙ্গে কয়েকজন পুরুষ বলতে থাকেন, ‘আর আপনারা যখন পুরুষদের সিটে বসেন?’

তাদের কথায় বোঝা গেল, যে উদ্দেশ্যে নয়টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে, তা নিয়ে বাসের চালক, চালকের সাহায্যকারী, পুরুষ যাত্রী—সবারই ধারণা হচ্ছে, ওই নয়টি সংরক্ষিত আসন ছাড়া বাসের আর কোথাও নারী যাত্রী বসতে পারবেন না। এ নিয়ে তাঁরা রীতিমতো নারী যাত্রীদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নেমে গেলেন। সাধারণ নারী যাত্রীদের এ পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য গণপরিবহনে চলাচলের বিষয়টি আরও কঠিন।

সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবা হয় না। নির্বাচনের সময়ে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি কীভাবে তাঁর সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে?
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান

ঢাকার তিনটি এলাকা বাড্ডা, তেজগাঁও এবং পল্লবী থানাধীন বাউনিয়াবাঁধে নিয়মিত ‘ফিল্ড ফ্যাসিলেটর’ হিসেবে কাজ করেন নাসিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হয়েও ১২ বছর ধরে আমি কাজ করছি। পরনির্ভরশীল হয়ে ঘরে বসে নেই আমি। কিন্তু প্রতিদিন আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে বাসে একটুখানি জায়গা পেতে আওয়াজ তুলতে হয়। নানা কটূক্তি শুনতে হয়। আমাকে বাসে তুলতে বা নামাতে একটু সময় দিতে হয় বাসচালক বা হেলপারকে। তাই কেউই আমাকে তুলতে চায় না।’

নাসিমা আরও বলেন, ‘আমি পুরো ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করি। ওঠানামায় সময় লাগে বলে তারা অনেক সময় হয়তো আমি পা বাড়ালেও বাস চলে যায়। আমরা কারও দয়ায় নয়, কাজ করে খেতে চাচ্ছি। কিন্তু সেইটুকু সংবেদনশীলতাও দেখাতে চায় না।’ তিনি আরও বলেন, তবে নিয়মিত সাভার রুটের যাত্রী হওয়ায় দু-একটি পরিবহনের বাসকর্মীরা তাঁকে কিছুটা চেনেন। তাই কয়েকটি পরিবহনের কর্মীদের কাছে অনেক সময় ভালো ব্যবহার পান তিনি। আবার অনেক সময় তাঁকে উল্টো চিত্রও দেখতে হয়।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন অনুসারে বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার নিয়ম রয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনে নারী যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কামরা বরাদ্দ রাখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে ১০ মার্চ রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। ট্রেনের প্রতিটি কামরায় শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে।

তবে আইনগতভাবে সুরক্ষার বা অধিকারের বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, পাশাপাশি বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা কতটা মানা হচ্ছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বলছেন প্রতিবন্ধীরা।

প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় কাউন্সিল দেশের ২৩টি জেলায় প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে কাজ করছে। সংগঠনটির সভাপতি নাসিমা আক্তার নিজে হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে পারেন না। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নাসিমা বলেন, কেবল প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে দীর্ঘ রুটের যাত্রায় তাঁকে বাসের টিকিট দেওয়া হয়নি। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষা আইন অনুসারে বাসে সংরক্ষিত আসনের কথা লেখা থাকে ঠিকই। কিন্তু অনেক সময় সে অধিকারটুকু দেওয়া হয় না। টিকিট কাউন্টারে গেলে প্রতিবন্ধী শোনার পর টিকিট কাটতে চায় না। অনেক সময় হেলপাররা সাহায্য করার নামে হয়তো শরীরে স্পর্শ করার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।

নাসিমা খাতুন আরও বলেন, সরকার তো প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক কাজ করে। কিন্তু এখনো সচেতন নন চালক, হেলপার কিংবা যাত্রীরা। তাঁদের সচেতন করার পাশাপাশি, প্রতিবন্ধী মানুষদের চলাফেরার জন্য সরকারিভাবে বাস চালু করা দরকার বলে তাঁরা মনে করেন। এ ছাড়া ট্রেনে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী কিংবা ক্রাচ নির্ভরশীল মানুষেরা যাতায়াত করতে অসুবিধার মুখে পড়েন। তাদের কথাও ভাবা দরকার।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘গণপরিবহনে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনসংখ্যার বিষয়ে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার আসলে কোনো প্রয়োগ হয় না বা দেখার কেউ নেই। আমাদের সড়ক কাঠামোই তো শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিরোধী। ফুটপাথ, রাস্তা বা যেকোনো অফিসই প্রতিবন্ধীদের সহায়ক নয়। অবকাঠামোগত পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা দরকার। রাস্তাঘাট থেকে ভবন নির্মাণ কোনো ক্ষেত্রেই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা হয় না। অনেক স্থানেই হুইল চেয়ার অ্যাকসেস থাকে না।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবা হয় না। নির্বাচনের সময়ে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি কীভাবে তাঁর সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে? প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এটা পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।